সকাল সাড়ে ১০টায় ঘুম ভাঙে ওর। তেলেভাজা রুটি খাওয়ার জন্য মায়ের নিকট থেকে ৫০টাকা নিয়ে কলতাবাজারে যায়। বাসা থেকে নাস্তার দোকানের দুরত্ব মাত্র ৫০-৬০গজ দূরত্বে। নাস্তা সেরেই বাড়ি আসার কথা ছিলো; বাজারে গÐগোল হচ্ছে শোনেই ছুটে যান তিনি। কলতাবাজারে বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতির সামনে তখন বিপ্লব দাঁড়িয়ে ছিলো। এক প্রান্তে পুলিশ, আরেক প্রান্তে আন্দোলনকারীরা; সেই অবস্থা দেখে মা ছুটে গেলেন সন্তানকে নিয়ে আসতে। তখন সেই পরিবেশ নেই। কয়েকটি দোকানের পিছন দিক-দিয়ে যখন সেখানে পৌঁছেন, ততক্ষণে গুলাগুলির শব্দ শোনতে পান। সেখানে পৌঁছে দেখেন গুলিবিদ্ধ অনেক মানুষকে অটোতে উঠাচ্ছে। মাহেন্দ্র গাড়িতে শুধু দু’টি পা দেখেই মায়ের আর্তনাদ ‘বিপ্লব, এ আমার বিপ্লব, এ তো বিপ্লব।’ সবাই আমাকে নিয়ে আসলো, চারপাশে কোথাও বিপ্লবকে আর দেখতে পাই নাই। নাস্তা সেরে আমার বিপ্লব আমার কাছে এসেছে, কোলেও নিয়েছি, গুলিবিদ্ধ বিপ্লবের জামাটা রক্তে ভেজা। আমার বুকে সে ফিরলো লাশ হয়ে।
কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত বিপ্লব হাসানের মা বিলকিস আক্তার। তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী অসুস্থ্য; কোমড়ের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। টাকার অভাবে দু’মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়। বাবার চিকিৎসা আর দু’বোনের লেখাপড়ার খরচ সংগ্রহ করতে বিপ্লব। সে ২০২৩সনে মোজাফফর আলী ফকির উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দেয়। সে বছর একটি বিষয়ে ফেল করায় ওই বিষয়ে আবারও ২০২৪সনে পরীক্ষা দেয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি কিষাণী ওয়েল মিলে মেকানিক কর্মচারী হিসাবে কাজ করতো। প্রতিমাসের পুরো বেতনের টাকাই তুলে দিতো মায়ের হাতে। দৈনন্দিন খরচের টাকাও নিতো মায়ের নিকট থেকে।
বিপ্লব হাসান ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের মো. বাবুল মিয়ার পুত্র। গত শনিবার (২০ জুলাই/২০২৪) উপজেলার কলতাপাড়া বাজারে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করে ৩জন। তাদের মধ্যে একজন হলেন বিপ্লব হাসান। অপর দু’জন হলেন মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের জোবায়ের আহম্মেদ ও রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও গ্রামের নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব।
নিহত বিপ্লব হাসানের বাবা মো. বাবুল মিয়া কলতাপাড়া বাজারের একজন ওয়ার্কসপ মেকানিক। এক ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে বিপ্লব ছিলো সবার বড়। বাবার অসুস্থ্যতার কারণে তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রায় ৩বছর পূর্বে চাকুরি নেন। কলতাপাড়া বাজারের পাশ^বর্তী চুড়ালী মৌজায় মাত্র ২শতাংশ জমিতে একটি টিনশেডের ঘরে তিন সন্তানকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন বাবুল মিয়া। পুত্র সন্তানকে হারিয়ে বারবার মোর্ছা যানা। তিনি বলেন, আমার ওষুধ কে কিনবে, দোকানটাও কে খুলবে; ও ছাড়া যে আজ আমি নি:স্ব।
তিনি আরও বলেন, আমি সিলেট গিয়েছিলাম। ছেলে আমাকে ফোন করে বললো, বাবা তুমি সাবধানে থেকো, সাবধানে এসো। সারাদেশে গÐগোল চলছে। শুক্রবারে এটা ছিলো, ছেলের সঙ্গে শেষ কথা। আমাকে সাবধান করে, অথচ সেই বুলেটের আঘাতে মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়লো। এ শোক আমি কিভাবে সইবো!
দাদা আব্দুল হাকিমের কবরের পাশেই চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন বিপ্লব হাসান। ঘটনার ১০দিন অতিবাহিত হলেও ছেলে হারানোর শোক ভুলতে পারছেন না। কবরের পাশে মায়ের আহাজারী, আয় বিপ্লব; চলে আয়, তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। এই তো তোর জন্য নাস্তাও তৈরি করেছি, চলে আয় ‘বাবা।’ সন্তানের কবরের পাশে এসে দু’চোখের অশ্রæবন্যা মুছতে মুছতে বাবুল মিয়ার কাধের গামছাও ভিজে ডু¹ুর হয়ে গেছে। ভাইকে হারানোর শোক সইতে না পেরে অসুস্থ্য হয়ে যান ছোট বোন ফারজানা আক্তার বাবলী। হাসপাতালের বিছানায় চোখ খোলেই শুধু ‘ভাই-ভাই’ বলে চিৎকার করছে। সে গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। আরেক বোন জান্নাতুল ফেরদৌস কলতাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।
আমার বংশের প্রদীপকে নিভে দিলো বুলেট; একটা গুলি কেড়ে নিলো আমার বিপ্লবকে। আমার নাতীকে যারা মেরেছে, আমি তাদের বিচার চাই, প্রধানমন্ত্রী কাছে আমি বিচার চাই। দু’হাত উপরে তুলে একমাত্র নাতীকে হারিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বিপ্লবের দাদী রোকিয়া আক্তার। তিনি বলেন, আমার নাতির মাথায়, গলায় আর পেটে তিনটা গুলি লেগেছে। এমন ছোট্ট শিশুকে ওরা কেনো মারলো; আমার নাতি তো কোনো রাজনীতি করে না, ওতো পেটনীতি করতে করতেই সময় যায়।
বিপ্লবের চাচী রুমা আক্তার বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট হত্যাকারীদের বিচার চাই। এই অসহায় পরিবারটিকে রক্ষা করুন। দু’টি মেয়ের লেখাপড়া আর বিপ্লবের বাবার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিন। ওদের তো আর কিছুই নাই, একেবারে নি:স্ব, অসহায় একটি পরিবার।
পুলিশের ওপর হামলা, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতীমূলক কাজ করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে পুলিশের কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগ ৬৪জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও ৫শ থেকে ৬শ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে। এ মামলাটি দায়ের করেন গৌরীপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর অনিক ইসলাম। এ মামলায় পুলিশ ৫জনকে গ্রেফতার করেন। তারা হলেন গৌরীপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ, রামগোপালপুর ইউনিয়নের গুজিখাঁ গ্রামের বাচ্চু মিয়ার পুত্র শাহ আলম, ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের মৃত আছির উদ্দিনের পুত্র সুলতান মাহমুদ, তারা মিয়ার পুত্র মোজাম্মেল হোসেন ও নন্দীগ্রামের আব্দুল কদ্দুসের পুত্র জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়াও ৩জন নিহতের ঘটনায় ৪০-৫০জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামী করে গৌরীপুর থানায় অপর মামলাটি দায়ের করেন এসআই মো. শফিকুল আলম।