বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আন্দোলনে সরব ছিলো গার্মেন্ট কর্মী মো. মোশারফ হোসেন। গণঅভ্যূত্থানের বিজয় নিশান উড়িয়ে রাজপথে নেমেছিলেন এ যুবক। আন্দোলন যেনো ডাকছিলো তাকে, তাই না খেয়েই বেড়িয়ে যান ‘এক দফা’র আন্দোলনে। সেদিন ছিলো সোমবার, ৫ আগস্ট ২০২৪। মিছিলে মিছিলে একাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাওনা এলাকা। একদফা’র ¯েøাগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো মোশারফ, সঙ্গে শত শত গার্মেন্ট কর্মী!
আন্দোলনকারীদের মাঝে খবর আসে, এদিক দিয়ে বিজিবি আর পুলিশ ঢাকায় ঢুকবে। ওরা ঢাকায় ঢুকে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হবে। তাৎক্ষনিক সৌখিনের একটি বাস দিয়ে রাস্তা ব্যারিকেড দেয়। সেই ব্যারিকেড সরাতে পুলিশ এতোপাতাড়ি রাবার বুলেট ছোঁড়ে। তারপররেও ব্যারিকেড ভাঙতে ব্যর্থ হয়। এরপরে দেড়-দু’শ শ্রমিক নিয়ে মোশারফ আরও এগিয়ে যায়। পুলিশ পিছু হটলে এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পুলিশের ২টি গাড়িও জ¦ালিয়ে দেয়। এরপরেই এ্যাকশানে নামে বিজিবি। টার্গেট করে একেএকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ১৫-২০জন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যান। একজনের লাশ কোলে নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে পড়েন মোশারফ। এরপরে তাকে টার্গেট করে গুলি ছোঁড়ে। দু’টি গুলি একেবারে ওর দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে ছিদ্র করে বেড়িয়ে যায়। কালো পিচঢালা রাস্তায় লুঠিয়ে পড়েন তিনি। কথাগুলো বলছিলেন গৌরীপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি রাজন।
‘বাঁচাও, বাঁচাও আর্তনাদে রক্তাক্ত মোশারফকে উদ্ধার করে সেদিন প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শালিহর ছায়ানীড় আবাসন প্রকল্পের ৭নং ব্যারাকের ৬৫নং কক্ষের বাসিন্দা মো. নাজিম উদ্দিনের পুত্র। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। বাবা পেশায় আবাসন মসজিদের মুয়াজ্জিন। বাবার বা তার বাড়ি-ভিটে নেই; সে জন্য আশ্রয় নেন সরকারি আবাসন প্রকল্পে। মূল বাড়ি ছিলো উপজেলার ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের পশ্চিম শালিহর এলাকায়। অভাবের তাড়নায় নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যান। ছেলে মোস্তফা কামাল, মোশারফ হোসেন, কন্যা নাসিমা আক্তার, জহুরা খাতুন, হালিমা খাতুন, ছালমা আক্তার আর স্ত্রী নুর জাহান বেগমকে নিয়ে আশ্রয় নেন এ আবাসনে।
হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন মঙ্গলবার (৬ আগস্ট/২৫) ছুটি দিয়ে দেন মোশারফকে। গৌরীপুর উপজেলা হাসপাতালে ড্রেসিং করার প্রতিদিন। সে মাসের ১৩ আগস্ট মোশারফের পা থেকে রক্ত বেরুতে থাকে। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজন। তার সহযোগিতায় ওইদিন ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওকে বাঁচাতে রক্তও দেন তিনি। আহত মোশারফের স্ত্রী মোছা. রহিমা খাতুন বলেন, ওইদিনেই তাকে ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসার খরচ যোগান দিতে ওর বাবার একটি গাভী ছিলো সেটা ৮০হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। আমার বাবার বাড়ি ও আত্মীয় স্বজনরাও সহযোগিতায় হাত বাড়ান। এরপরেও বিভিন্ন জনের নিকট থেকে ধার-কর্জ করে চিকিৎসা করা হয়। এরপরে নেয়া হয় ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনের সূত্র ধরেই চিকিৎসায় সহযোগিতা করেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী মো. খলিলুর রহমান। ঢামেক হাসপাতালে ভর্তির ৭দিন পর থেকে শুরু হয় সরকারি চিকিৎসা। এর আগেই পরিবার ও স্বজনের নিকট খরচ হয় আরো প্রায় ৩লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, ওর চিকিৎসার জন্য বোর্ড বসানো হয়। সেই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী থাইল্যান্ডে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত হয়। আমাদেরকে জুলাই ফান্ডেশন থেকে চিকিৎসার জন্য এক লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। সরকারি খরচে ১৪ জানুয়ারি থেকে চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
মোশারফের সঙ্গে থাইল্যান্ডে রয়েছেন মো. শাহিনুর ইসলাম। তিনি উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের নন্দীগ্রামের মো. শফিকুল ইসলামের পুত্র। ডিগ্রী ১ম বর্ষ গৌরীপুর সরকারি কলেজ অধ্যয়নরত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৯জুলাই অনুষ্ঠিত কলতাপাড়ার বিক্ষোভ মিছিলে সক্রিয় অংশ নেন। তিনি জানান, মোশারফের চিকিৎসা চলছে ব্যংকক ভেজতানি হাসপাতালে। ওর ডানপায়ের উরুর একেবারে মাঝ বরারর হাড় ছিদ্র হয়ে গুলি বেড়িয়ে যায়। বামপায়ের একই স্থানে হলেও হাড়ের পাশ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। শনিবার (১৮ জানুয়ারি/২৫) মেডিকেল টিম চেকআপ শেষে তার চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেছেন।
মোশারফ হোসেন বিয়ে করেন ২০১৪সনের ১ডিসেম্বর। দাম্পত্য জীবনে দুই কন্যার জনক। বড় মেয়ে শারমিন আক্তার মীম বর্তমানে তারাকান্দা উপজেলার বিসকা ইউনিয়নের ভাটিয়াপাড়া কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত। ছোট মেয়ে ৩বছর বয়সী জিনিয়া আক্তার রোখাইয়া। দু’সন্তানকে নিয়ে এখনও মাওনায় ভাড়া বাসায় আছেন রহিমা খাতুন। তিনি বলেন, কোথায় যাবো; আমাদের যাওয়ার জায়গাও তো নেই! প্রতি মাসে ৪হাজার টাকা ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস খরচ নিয়ে অনেকটাই বিপাকে আছি। যে টাকা পেয়েছিলাম, সেটা ডলার করে দিয়ে দিয়েছি। স্বামীর চিকিৎসা, সন্তানদের ৩ বেলার খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়ার খরচ সবমিলে চলার তো কোনো পথ নেই!
সন্তানের চিকিৎসা ও সংসারের হাল ধরতে গিয়ে ৮০ছুঁইছুঁই করা নাজিম উদ্দিনও এখন দিশেহারা। মসজিদের মুসুল্লিদের নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ছেলের সুস্থ্যতার জন্য নিত্যদিন সৃষ্টিকর্তার নিকট কান্নাকাটি করেন। তিনি বলেন, আমার ছোট মেয়ে ছালমা আক্তারের স্বামীও কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এক সন্তান নিয়ে মেয়েটি আমার এখানে আছেন। ছেলে-মেয়ে, নাত-নাতীদের কোথায় ঠাঁই দিবো, আমার নিজস্ব কোনো ভূমি নেই; এ জন্য আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাস করি।
এ প্রসঙ্গে গৌরীপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নুর মোহাম্মদ সিদ্দিকী রাজন জানায়, মোশারফ হোসেনের পরিবারটি অত্যন্ত অসহায়। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সে ছিলো অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। দু’টি পায়ের মধ্যে গুলিবিদ্ধ স্থানে পচন ধরে। তার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয় বহুল। সরকারের পক্ষ তা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী মো. খলিলুর রহমান জানায়, আমরা মোশারফ হোসেন এর চিকিৎসা ও তার পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।
গত সোমবার (১৩ জানুয়ারি/২০২৫) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইসের একটি বিমানে সকাল ১১টা ৫মিনিটে থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ১৪ জানুয়ারি থেকে ব্যাংক হাসপাতালে তার চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।