আজ শুক্রবার ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

||
  • প্রকাশিত সময় : মে, ২৬, ২০২০, ৯:২২ অপরাহ্ণ




ধর্ষণ পিতৃতান্ত্রিক হিংস্রতা : লুৎফর রহমান

পিতৃতন্ত্র আদিতে নারীকে সম্পত্তি ও কর্তৃত্ব থেকে ছিটকে ফেলে দিয়ে যাত্রা শুরু করে। সে প্রথম পরিবারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, তারপর রাষ্ট্র ও সমাজে। পুরুষতন্ত্রের এই আধিপত্যই হিংস্রতার মূলে। সমাজে সে ধীরে ধীরে তার আদর্শের প্রতিষ্ঠা করে। এখন এই প্রতিষ্ঠিত আদর্শই তার স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা রাখছে। পুরুষতন্ত্র তার আদর্শ বাস্তবায়নে দুটো পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। ১.সামাজিকীকরণ ২. বলপ্রয়োগ।

১. সামাজিকীকরণ:

পুরুষতন্ত্র তার সবকিছুকে নানা কৌশলে সমাজে সহনীয় করে তোলে এটাই সামাজিকীকরণ। সে জোর প্রচার চালায় পুরুষের ব্যভিচার কোনো দোষের না, কিন্তু নারীর বেলায় সেটা অপরাধ। নারী পুরুষ থেকে পৃথক ও নিকৃষ্ট জীব, মানুষ না। পুরুষ নারীর মালিক। মালিক তার মালিকানার বস্তু বা প্রাণীর ওপর যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, নারীর ওপরও পুরুষ সেরকম পারে। নিম্নবিত্তের পুরুষ সাধারণত নারীকে পীড়ন করে সামাজিকভাবে আর উচ্চবিত্তরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এটাই পার্থক্য। নারীর ঋতুস্রাব অস্পৃশ্য বিষয় এটা পুরুষতন্ত্রের প্রচার। এই সময়টাতে নারীকে পুরুষ ঘেন্নার দৃষ্টিতে দেখে এবং দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। সে যোনিকে অপূর্ণ অঙ্গ এবং পুংলিঙ্গকে গৌরবের অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, এটা সোনা, ধন-এর মতো মূল্যবান। সমাজে পুরুষ শ্রেষ্ঠ এবং এটা তার অধিকার। তাই আচার-অনুষ্ঠানে তার প্রাধান্য, তার খাবারটা আগে পরিবেশন করতে হয় যা নারী মেনে নেয় বিনা বাক্যব্যয়ে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে (জানাজা) নারীর উপস্থিতি অনুমোদন করা হয় না। বিশ্ব এজতেমার আখেরি মুনাজাতে নারী রাষ্ট্রনায়ক কোনো স্থাপনার ছাদে বসে অংশ নেন। যৌনপ্রাণী হিসেবেই নারীর জায়গা পুরুষের কাছে – এটাই সামাজিক ধারণা। নারীর যোনি ও জঠরের মালিক পুরুষ। এসব বিষয় সমাজের মানুষ যাতে সহজে মেনে নেয় এ ব্যাপারেই নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার চালায় পুরুষতন্ত্র।

২. বলপ্রয়োগ:

পুরুষতন্ত্রের অত্যাচারি আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে বলপ্রয়োগ। সমাজের ক্ষমতা পুরুষের হাতে। যদিও কোনো কোনো দেশে নারী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তবু সমাজের ক্ষমতা পুরুষের হাতেই থেকে যায়। পুরুষ সরাসরি শক্তি প্রয়োগ করে তার আদর্শ বাস্তবায়ন করে। কখনো সে ধর্মীয় বিধান কাজে লাগিয়ে বল প্রয়োগ করে। ব্যভিচারের শাস্তি স্বরূপ নারীকে সে পাথর মেরে হত্যা করে, নারীর জীবনের মালিকও পুরুষতন্ত্র। পারিবারিক রীতি ও রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমেও নারীর ওপর বল প্রয়োগ হয়। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিবার প্রধানের নির্দেশে নারীর বিয়ে করতে হয়। প্রবল ইচ্ছা থাকলেও পুরুষ প্রধানের নির্দেশে নারীর শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। প্রচুর যোগ্যতা থাকলেও নারী স্বামীর অনিচ্ছার কারণে চাকরি করতে পারে না বা তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। কোনো কোনো দেশে রাষ্ট্র আইন করে দেয় নারী কোথায় যেতে পারবে বা পারবে না, এবং কী পোশাকে যাবে, কী করতে পারবে বা করতে পারবে না। এখানে নারীর ইচ্ছা এবং যোগ্যতার কোনো মূল্য নেই। নারীর মর্যাদাও আইন করে ঠিক করে দেয়া হয়, যেমন- সৌদি আরব ও পাকিস্তানে একজন পুরুষ সমান দুইজন নারী।

এভাবে সামাজিকীকরণ ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র নারীকে প্রতিনিয়ত বলাৎকার করে চলেছে। এ বলাৎকার হয় দু ধারায়। মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে। মেয়েটিকে যখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হলো তখন তাকে মানসিকভাবে বলাৎকার করা হলো। বিয়ের পর স্বামী পুরুষটি যখন সময়ে-অসময়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হলো তখন সে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হলো। যেমন ধরুন অফিসের বস সুন্দর নারী কর্মচারীকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কাছে ডাকছে, রূপের প্রশংসা করছে, বাসায় পৌঁছে দিতে চাইছে, সফরসঙ্গী হতে প্রস্তাব দিচ্ছে আর নারীটিকে তা বিষের মতো গিলতে হচ্ছে পরিবারের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। এটা পুরুষতন্ত্রের মানসিক বলাৎকার। তারপর আরেকদিন দেখা গেলো বস বীর পুরুষটি তার স্টাফদের সহযোগিতায় রুমের দরজা বন্ধ করে নারীটির সর্বনাশ করেই ফেললো। মসজিদের ইমাম তার মক্তবের ছাত্রীটিকে প্রতিদিন বলছে ওস্তাদের কথা না মানলে বেহেস্ত হারাম হয়ে যায়। তারপর একটু একটু করে কু-ইঙ্গিত করছে- এটা মানসিক বলাৎকার তারপর শারীরিকভাবে ধর্ষণ। দেখা গেলো মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট তার ছাত্রীটিকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবে ভয় দেখিয়ে গরিব মেধাবী ছাত্রীটির শ্লিলতাহানি ঘটালো। অথবা কোনো সেনাশাসক দেশের বিখ্যাত সংগীত শিল্পীকে সাক্ষাৎকারে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করলো। সারকারি দলের ছাত্রনেতা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেন্সুরি-উৎসব করলো। একদল দস্যু প্রকৃতির যুবক কোনো নারীকে রাস্তায় একলা পেয়ে তার সর্বনাশ করলো। বাসে-ট্রেনে-স্টিমারে-রেলে নারী ধর্ষিত হলো। বাসে ভিড়ে নারীর পাছায় বা বুকে খুঁচা দেয়া হলো। মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণ করা হলো। পুলিশ হেফাজতে নারী ধর্ষিত হলো। রাজনৈতিক নেতা তার নারী কর্মীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করলো। মাতবর-খালু-চাচা-সৎবাবার বলাৎকারের উদাহরণ বিরল নয়। সবের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক হিংস্রতা, আধিপত্য, ক্ষমতা দায়ি। সমাজ যতো উন্নতই হোক পুরুষতন্ত্রকে ধ্বংস করে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর পক্ষে এখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না।(চলবে)——– ২৩/০৫/২০২০ খ্রিঃ।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০