আজ শনিবার ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম:
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে সুসংহত করতে হবে-ধর্মমন্ত্রী ময়মনসিংহ – শেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের ১৮কিঃ মিঃ সড়ক দূর্ঘটনা কবলিত পরিণত গৌরীপুর ছাত্র ইউনিয়নের ৭২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ভাষা সৈনিক এম.সি.এ হাতেম আলী মিয়ার ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত ফেইসবুকে ধর্মীয় মুল্যবোধে আঘাত করায় জিকেপি কলেজের প্রদর্শক সুনীল গ্রেফতার তারাকান্দায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে এক কৃষকের মৃত্যু তারাকান্দায় ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ী যুবক খুন ময়মনসিংহে ট্রেনের ধাক্কায় স্বামী-স্ত্রী নিহত তারাকান্দায় দোকানের বাকি নিয়ে সংঘর্ষে পুত্র খুন : বাবা আহত গৌরীপুর বিশ্ব বই দিবস পালিত
তাসাদদুল করিম || ওয়েব ইনচার্জ, দৈনিক বাহাদুর
  • প্রকাশিত সময় : ডিসেম্বর, ৩, ২০২৩, ৭:৪৪ অপরাহ্ণ




মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা রণাঙ্গন’৭১ : বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: ইকবাল হাসান খান

আমি মো. ইকবাল হাসান খান তখন বেঁচে থাকবো, মরবো, সেই চিন্তা-ভাবনাটা কখনও মনে আসেনি। আমার বাবার আব্দুল হামিদ খান ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন। বাড়িটা ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের অষ্টঘর (কোর্টবাড়ি) গ্রামে। দাম্পত্য জীবনে দুই পুত্র সন্তানের জনক। সন্তানদ্বয় হলেন মো. মামুনূর রশিদ ও মো: মেহেদী হাসান মিথুন। সুফিয়া বেগম হলেন আমার স্ত্রী। আমার ভারতীয় তালিকায় ক্রমিক নং ৯৮০৫, লাল মুক্তিবার্তা নং ১১৫১১০১৭২, বেসামরিক গেজেট নং ৭৪৪, মুক্তিযোদ্ধা নং ০১৬১০০০৩৯৩০, সেনা গেজেট ১২৪৬৬।

৭১’রে মদন মধ্যখালি, ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ির রায়ের বাজার, রয়েলবাড়ি, কেন্দুয়ার ষাটপুর, ঈশ্বরগঞ্জ থানা আক্রমণে সম্মুখযুদ্ধ, মাইজহাটি রেলসেতু ও রামগোপালপুর আর ঈশ্বরগঞ্জ মাঝামাঝি কুটিয়াপুরি সেতু ধ্বংস করার অপারেশন করেছি। সেই সময় থেকেছি সহনাটী ইউনিয়নের পাছার ও নেত্রকোণার ভূইয়ার বাজার এলাকায়।

৭১’রে আমি ম্যাট্টিক (এসএসসি) পরীক্ষার্থী ছিলাম। সন্ধ্যায় কুপিবাতি জ¦ালিয়ে পড়ছি, ঠিক সেই সময়ে গ্রামে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। প্রায়শ: শোনা যাচ্ছিলো পাক-বাহিনী আসতেছে, আসতেছে বলে। খাকী রঙের পোশাকের প্রতি সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতি বিরাজ করছিল। হাট-বাজারে যেতে, মা-বাবা বারবার শুধু সাবধান করতো, কী; এক ভয়ানক দিন যে, শান্তিতে বাড়ির বাহিরেও যেতে পারছিলাম না। প্রতিদিন গ্রামের সবাই রেডিও’র সংবাদ শুনে, যুদ্ধ লাগতাছে, যুদ্ধ! এ কী, এক অজানা শংকা নিয়ে প্রতিদিন পরিবারের সবার চোখে মুখে টেনশন! বাবা-মা; আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো আমরা কোথায় যাবো? পাকিস্তানীরা আমাদের সঙ্গে যে বিমাতাসুলভ আচরণ করে তার প্রতিবাদে অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকুরী বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আমাদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই একাএকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবার যুদ্ধে অংশ নিবোই।

এরমধ্যেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, আমার শরীরের পশমগুলো দাঁড় করিয়ে দেয়। দৃঢ়তা বেড়ে যায়। যুদ্ধ যাবো, যাবোই। হৃদয়ের মাঝে ভাষণের প্রতিটি কথা, শব্দ আমার উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ডাক’ দেন তাই তো আমার মতো লাখো যুবকের প্রেরণা জুড়িয়েছে। এই মহান নেতার বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যা এখনও শুনলে আমার গা শিউরে উঠে। এই বজ্রকন্ঠের কথা শুনেই গ্রামের কয়েকজন ইতোমধ্যে যুদ্ধে চলে গেছে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধে যাবো।
আমরা তিন ভাই আর ছয় বোন। তাদের মধ্যে আমি ৪র্থ সন্তান। সে সময় বড় ভাই আব্দুল হেলিম খান পাঠান ও আব্দুল হেকিম খান পাঠান ছিলেন বিবাহিত। বড় বোন সালেহা খাতুন আর আছিয়া আপারও বিয়ে হয়ে গেছে। আমারতো পড়ালেখার চাপ সামনে ম্যাট্টিক পরীক্ষা। পরিবারের সবার আশা আমি ভালো রেজাল্ট করবো। আমার ছোট চার বোন, তারা হলো সুফিয়া খাতুন, বকুল খাতুন, খালেদা খাতুন ও লতিফা খাতুন। যুদ্ধে যাবো, মা-বাবা আর ভাইবোনদের কথা ভাবতাম, ওদের কী হবে!
বঙ্গবন্ধু’র প্রেরণা সব ভাবনাকে উড়িয়ে দিলো, যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। যাদের সঙ্গে কথা হলো এরমধ্যে কদ্দুছ আর হাদি চলে গেছে। আমি আর আব্দুল কুশি ভোরে চলে যাওয়ার পরামর্শ করলাম। ও তখন আনসারে চাকুরি করতো। কুশি বিষয়টা ওর মাকে জানিয়ে দিলো। ওর মা, জেনে তাৎক্ষনিক ভোরে চলে আসলো আমার মায়ের কাছে। কুশি’র আগমনের আশা ছেড়ে দিয়ে ততক্ষণে আমি কলেজের কোনো গৌরীপুর-শাহগঞ্জ সড়কে উঠে গেছি (বর্তমান জেলখানা মোড়)।
আমাকে ফেরাতে সাইকেল নিয়ে তখন হাজির হলো শামছুদ্দিন। সে তো কোনোভাবেই আমাকে যেতে দিবে না। বারবার মায়ের কথা বলে, বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে চাইলো। মায়ের কসম দিয়েও কথা বললো; কিন্তু তখন মনের মাঝে একটাই ইচ্ছে যুদ্ধে যাবো, যুদ্ধে যাবো। মনে হচ্ছিলো, যুদ্ধ একদম সামনে। ও; আর আমাকে আটকাতে পারলো না। ওকে, পিছনে পেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ দ্রæত হেঁটে সামনে চলে গেলাম। সামছুদ্দিন তখনও রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে আছি, ও কাঁদছে! আমি তাকালাম, আমার হৃদয়েও কান্নার ঝড় বইছে, কিন্তু যুদ্ধের শব্দ; কান্নার শব্দ আমার তখন কানে বাজেনি। চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে, তবে পা, পা করে হাঁটছি, ভাবছি ‘ওদেরকে খতম না করে ঘরে ফিরবো না।’
গৌরীপুর রেললাইনে উঠে গেলাম। হাঁটতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম, কোথায় যাবো? তখনই মনে পড়ে যায় শরাফ উদ্দিন খান পাঠানের বোনের বাড়ি তো পূর্বধলায় ওদের বাড়িতে যাবো। পূর্বধলার ব্রিজটি পার হওয়ার আগেই পুর্বপাশে ওদের বাড়ি। বাড়ির সামনে হাজির হলাম শরাফ উদ্দিন খান পাঠানের বোনকে পেলাম। আমাকে দেখেই ভগ্নিপতি শহিদুল্লাহ এগিয়ে আসলেন। তারপর আমাকে নাস্তা দিলো। দুপুরের গোসল করে ভাত খেয়ে রওয়ানা হলাম। শহিদুল্লাহ জানালো, আজকে গোয়াতলার বাজার, যেতে কোন সমস্যা হবে না।

রেললাইনে উঠিয়ে শহিদুল্লাহ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি হাঁটতে লাগলাম। দুপুরের সূর্য্যটা হেলে গেছে। নিজের ছায়া মাড়িয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে হলো সেই! কিছু দূর যাওয়ার পর পিছনে তাকিয়ে দেখি শহিদুল্লাহও চলে গেছে। আর তিনি তো অনেক কিছুই করলেন। সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, আমার সামনে আরও দু’জন হাঁটছে। কানপেতে ওদের কথা শোনলাম, কিছুদূর যাওয়ার পর নিশ্চিত হলাম ওরাও যুদ্ধে যাচ্ছে। ততক্ষণে আমার নিত্যসঙ্গী ছায়াটা লম্বাটে হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে দু’একটা পাথরের দেখা মিলে, সেগুলো পায়ে দু’চার বার হোঁচট খেয়েছি। তারপরও বিরামহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। বিকাল হয়ে আসছে মোর একমাত্র সঙ্গী ছায়াটা বিদায় নিয়েছে। এক দু’পা বাড়িয়ে সামনের দু’জনের সঙ্গে মিলে গেলাম

নতুন সঙ্গী একজন হলেন কিতাব আলী। তার বাড়ি ফরিদপুর, বাবুল অপেরা পার্টিতে কাজ করতেন। আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়, তার নামটি আজ মনে নেই। তিনি ছিলেন দাঁতের ডাক্তার। রাতে ওই ডাক্তারের আত্মীয় ধর্মবোনের বাড়িতে রাত্রিযাপন করি। ওই বাড়ি থেকে একটি চিঠি লিখে দেন ভুট্টা গ্রামের আজিজ মাস্টারকে দেয়ার জন্য। পরদিন সকালে ভুট্টা গ্রামে যাই। তিনি সেই গ্রামের আজিজ মাস্টারের নিকট পত্রটা তুলে দেন। আজিজ মাস্টার পত্রটা পাওয়ার পর খোঁজখবর নিয়ে জানান দেন যে, ওই পাড়ে যেতে এখন কোন সমস্যা নেই। এরপর রওয়ানা হয়ে ঘুষগাঁও চলে যাই। ঘুষগাঁও থেকে নদী পাড়ি দেই।
সারাদিন ওই মাঝি’র তেমন ইনকাম হয়নি। তবে ও যখন বুঝলো আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি তখন বিনাপয়সায় আমাদেরকে নদী পাড় করে দেন। দেশের প্রতি ২০-২৫বছরের সেই যুবকের উদারতা দেখে অবাক হলাম। এই যুবকের দেশের প্রতি যে দরদ তা দেখে আমাদের দরদ আরো বেড়ে গেলো।
নদী অতিক্রম করে ৭১’র ২৭জুলাই বিকাল ৩টায় শিববাড়ি ক্যাম্পে পৌঁছে যাই। ছোট পাহাড়ের সমতলে বিএসএম ক্যাম্পের নিচে টিলায় মধ্যে থাবুতে ক্যাম্পে হাজির হলাম। ওই ক্যাম্পে ছিলেন হাতেম আলী মিয়া, ডা: আব্দুস সোবহান ও গৌরীপুরের পরিচিত আরো অনেকেই। প্রশিক্ষনে যাওয়ার আগে ময়মনসিংহ মেডিকেলের ছাত্র নেতা মুজিব (ডা. ক্যাপ্টেন অব. মজিবুর রহমান ফকির) ও টাঙ্গাইলের এমসিএ ডলি আপা’র সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে ৭১’র ৩১জুলাই আর্মির গাড়ীতে করে তোড়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যাই। এরপরে মুজিব ও ডলি আপা’র সঙ্গে আর দেখা হয়নি। সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছিলো ৯৯৬জন গেরিলা।

নতুন জীবন শুরু হলো গোল থাবুতে। একে অপরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো। আসলো সবার হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। অস্ত্রটা হাতে পেয়েই ভেবেছিলাম, আয় এখন! দেখবো তোদের; গুলি করে মারবো সব পাকিস্তানী দোসদের। শরীরটা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, আমার দেশের মানুষের ওপর ওদের নির্যাতনের বর্বারোচিত চিত্রগুলো। শুরু হলো এই অস্ত্রের খোলা- জোড়া, ফায়ারিং। প্রশিক্ষণে এলো অস্ত্র এসএলআর, এলএমজি, নাইন এমএম ও এছাড়াও নানা প্রশিক্ষণের অস্ত্র। প্রতিটা বুলেট নিশানাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, শিউরে উঠছেন প্রশিক্ষকগণও। শুধু আমি নই; প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া প্রত্যেকের টার্গেট মিস হচ্ছে না, তা দেখে সবাই অবাক। কেননা, আমাদের টার্গেট তো তখন সবার এক, নিশানা এক! প্যারেড কমাÐার ছিলেন শামছুজ্জোহা নেত্রকোনার। ২১দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ২১আগস্ট কসম প্যারেড গ্রহণ করি। সেখান থেকে জঙ্গলপ্যারেড করাতে আসামে চলে যাই। শীতকালীন প্রশিক্ষণ ন্যায় আমাদেরকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। কখন আমরা খেয়েছি, কখন খাইনি, এই ক’দিন সেটা ভুলে গেছি। প্রশিক্ষণ শিবিরে কী যে মহব্বত ছিলো; একদিন জ্জোহা ভাইয়ের এখানে পানি নেই, দেখা গেলো সবাই নিয়ে নিয়ে হাজির। কেউ অসুস্থ্য হলে সবাই তার খোঁজ নিতো। নিজে না খেয়ে, একজন অন্যজনকে খাবার দিয়ে দিয়েছে। প্রশিক্ষণের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট ও ঘন্টা কেটেছে শুধুমাত্র শত্রæ বাহিনীর ওপর কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বো, তার রণকৌশলে।

রক্তের শিরা-উপশিরা ছটফট করছে, কখন দেশে ফিরবো। সেখানে থেকেই খবর পাচ্ছি, শত্রæ বাহিনী আমাদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিয়েছে। দেশের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলছে। মা-বোনদের ধরে নিয়ে ওরা ধর্ষণ করছে, লুটতরাজ চালাচ্ছে। প্রত্যেকটি খবর শুনে, প্রতিরোধের বারুদ যেন রক্তে বইতে শুরু করলো। অস্ত্র হাতে নিয়ে শপথ নিলাম, মরবো তবু দেশকে শত্রæমুক্ত করবো। মা-বাবার চেহারা ভেসে আসতো, ভাই-বোনদের কথা মনে হতো, ওরা কেমন আছে জানতে ইচ্ছে হতো, ছটফট করতাম। মা-বাবা কেমন আছে? গৌরীপুরের নতুন কেউ গেলে ওর নিকট খবর জানতে ছুটে গেলাম। দিন-রাত অস্ত্রের তালিম, বাঙ্কার তৈরি, শত্রæকে ফাঁদে ফেলার কৌশল ততক্ষণে লপ্ত করেছি। এসবের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো জঙ্গল প্যারেড।
অক্টোবরের ৪ তারিখ মহিষখলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসি। সেখানে অধিনায়ক ছিলেন সেকান্দর নূরী। ওই রাতেই আমরা ৯টা ৫০মিনিটে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। আমাদের সাথে ছিলো ১২টা নৌকা। আমরা ছিলাম ১৮জন। ডিঙ্গাপুতার হাওড় অতিক্রম করে মধ্যখালি আসি। ১১ অক্টোবর প্রথম অপারেশন আঠারবাড়ি রায়ের বাজার এক্সচেঞ্জ পুড়িয়ে দেই। আগুন জ্বলছে ঠিক সেই মুর্হূতে পাকবাহিনীও আক্রমণ করে। আমি লাফ দিয়ে পুকুরে পরে যাই। মাথায় কচুরিপনা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি। শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন অনেকটা শীতও ছিলো। তারপর সামনে রয়েলবাড়ির দিতে এগুতেই দেখি চেয়ারম্যান বাড়ি। ওই বাড়িতেই উঠি চেয়ারম্যানের মা (নাম জানা নেই) আমাকে দেখেই খুব আদর-যতœ করেন। নিজের হাতে শুকনো কাপড় দিয়ে শরীরটা মুছে দেন। হারিকেন জ্বালিয়ে আমাকে উষ্ণতা দেন।
সিদ্ধান্ত হলো মাইজহাটির রেলসেতু ব্রিজ ভেঙে দিবো। সেদিন আমরা ১৮জন গেরিলা। কমান্ডার ছিল কাজী হাসানুজ্জামান হিরু ভাই। ২২ অক্টোবর মাইজহাটি গ্রামে শুক্রবার মাইজহাটির আব্দুর রহিম মাওলানার বাড়িতে সন্ধ্যার দিকে খাওয়া দাওয়া করি। এরপর ওইদিন রাতে মাইজহাটির রেলসেতু ভাঙ্গার জন্য যাই। রাজাকার পাঁচজন ব্রিজে পাহারা দিচ্ছিল। তারা অস্ত্রসহ আমাদের নিকট আত্মসমর্পন করে। রাত প্রায় ১/২ টার দিকে রেলসেতু ধ্বংস করা হয়। সেই সময় রেলসেতুর সঙ্গে টেলিফোন লাইনের বেশ কয়েকটি খুঁটিও ধ্বংস করা হয়। রামগোপালপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ রাস্তার কুটিয়াপুরি সেতু ধ্বংস করি।
২৩অক্টোবর শনিবার ঈশ্বরগঞ্জ থানা আক্রমণের জন্য দত্তপাড়া যাই। সেখানে থেকে আক্রমণ করি। ফজরের আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। আমরা ক্রোলিং করে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে আসার সময় থানায় থাকা পাকবাহিনী আঁচ করতে পারে। ধানক্ষেতের পাশেই ছিলো ছোট খাল। আমাদের ওপর থানা থেকে ফায়ার শুরু করেছে পাকবাহিনীর সৈনিকরা। থানার পশ্চিমপার্শ্বে জমির বড় আইল ছিলো, আইলেই ছিলো বড় একটি কড়ই গাছ। আইলের এপার থেকে আমরাও ফায়ার করতে থাকি। এভাবেই সারাদিন গুলি বিনিময় চলতে থাকে। এরপর নেমে এলো গোধূলীর অন্ধকার। আমার বাম পাশে ছিল সুলেমান ভাই। নয়জন খাবার খাওয়ার জন্য চলে গেল।

আমরাও খুব ক্ষুদার্থ। ঠিক এই মুর্হূতেই মতি ভাই এলো মুড়ি-মিসরি নিয়ে। সুলেমান ভাই জিজ্ঞাসা করলো, এই ইকবাল; মতি ভাইরে চিনোস? বললাম না তো। মতি ভাই বললো, তোমার বাড়ি কোথায়, আমি বললাম। বোকাইনগর। মতি ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি বললেন ‘বীরআমুদপুর।’ তখন মতি ভাই আমার আর সুলেমান ভাইকে মুড়ি মিসরি দিলো। হঠাৎ কিসের শব্দ হইতেছিল মতি ভাই সেই কড়ই গাছের আড়াল থেকে দেখতে চেয়ে ছিলো। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার মাথায় লাগে। আমাদের হাতে মুড়ি-মিসরি মাটিতে পড়ে গেলো। তার আগেই মাটিতে লুঠিয়ে পড়লো মতি ভাইয়ের দেহটা। আমি চিৎকার দিয়ে বলি, মতি ভাই, মতি ভাই! মতি ভাই নাই; সবাই চলে গেল। সুলেমান ভাই আর আমি তখনও এলএমজি দিয়ে ব্রাস ফায়ার করতে থাকি। সিদ্ধান্ত হলো, পিছু হটতে। আমরাও উডল করি।

মতি ভাইয়ের নিথর দেহটা সেই কড়ই গাছে নিচেই পড়ে রইলো। কড়ই গাছে ঠিক দাঁড়িয়ে রইলো তার অস্ত্র এসএলআর। আমরা মতি ভাইয়ের দেহটা আর তার অস্ত্রটা আনতে পারি নাই। মাত্র ৭০/৭৫গজ দূরে আসার পর কান্নার শব্দ পেলাম ‘মা’ মা‘’ বলে চিৎকার। পানি, পানি, পানি দাও বলে চিৎকার করছিলো। চেয়ে দেখি আমাদের নিকট থেকে উডল করে যাওয়া হাতেম’ই এভাবে চিৎকার করছে। আমরাও তার কাছে যেতে পারলাম না। পরে তাকে ধরিয়ে দেয় দত্তপাড়া গ্রামের আক্কাস বেপারী। এরপরে জানতে পারি হাতেমকে নির্মমবাবে হত্যা করা হ। তাকে জবাই করে জমাদার ইদ্রিছ। আমাদের কমান্ডার ছিলেন হাসানুজ্জামান হিরু। তার বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের তুলনধর গ্রামে। আর পূর্বপাশে যারা যুদ্ধে অংশ নেয় তারা ছিলেন সালাম গ্রæপের ও অন্যান্য গ্রæপের মুক্তিযোদ্ধারা।

সেই স্মৃতিময় দিনের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে। যে মতি ভাই শহিদ হলেন তার বাড়ি আমার গৌরীপুরের বীরআহাম্মদপুরে। মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই সময় থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এমন ভুল সংবাদে সেখানে যায় সালাম গ্রæপের তিন জন। ওই রাতে থানায় যাওয়ার পর তারা শহিদ হন। ঈশ^রগঞ্জ থানা অপারেশনে শহিদ হন গৌরীপুর গিধাউষার আনোয়ার হোসেন দুলাল, বীর আহাম্মদপুরের মতিউর রহমান মতি, গৌরীপুরের আব্দুল মান্নান, ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলার শামসুর রহমান, জাটিয়ার তাহের উদ্দিন, আব্দুল খালেক, হরিপুরের হাতেম আলী ও অজ্ঞাতনামা আরেকজন, তার পরিচয় আজও জানা যায়নি।

(মো. ইকবাল হাসান খান)
পিতা- আব্দুল হামিদ খান
মাতা- আমেনা খাতুন
স্থায়ী ঠিকানা : অষ্টঘর (কোর্টবাড়ি), বোকাইনগর ইউনিয়ন
বর্তমান ঠিকানা : পূর্বদাপুনিয়া খেলার মাঠ, পৌরসভা
গৌরীপুর, ময়মনসিংহ।
মোবাইল নং : ০১৯৫২-১৯৬৭৪১
ভারতীয় তালিকায় ক্রমিক নং ৯৮০৫
লাল মুক্তিবার্তা নং ১১৫১১০১৭২, বেসামরিক গেজেট নং ৭৪৪
মুক্তিযোদ্ধা নং ০১৬১০০০৩৯৩০, সেনা গেজেট ১২৪৬৬।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০