গণজীবনের গতিধারা বিচিত্র। একজন গণমানুষের শিল্পীকে এ ব্যাপারে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হয়। তাঁর মানুষের হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে স্পর্শ করার ক্ষমতা থাকতে হয়। সোমেন চন্দের তা ছিলো। খেটেখাওয়া মানুষদেরকে তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। তিনি ঢাকা শহরে থেকে পড়াশোনা করলেও ছুটির সময়টা গ্রামে কাটাতেন। সোমেনের ছিলো তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি যা দিয়ে তিনি গ্রাম-শহরের মেহনতিদের পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি রেল শ্রমিকদের মাঝে কাজ করার সময় তাদের জীবনের ব্যাপকতা নিয়ে ভাবতেন, বোঝার চেষ্টা করতেন। শ্রমিকদের মাঝে তিনি গ্রামের জানা মানুষদেরকে দেখেছিলেন পরিবর্তিত পরিবেশে সংগঠনের ভূমিকার কারণে কেমন বদলে যায়। ‘সংকেত’ গল্পটিতে আমরা তা খুঁজে পাই।
জন্মগতভাবেই মানুষ স্বাধীনচেতা। কখনো এই চেতনা দমে থাকে, আবার কখনো ভুলপথে চালিত হয়, বা কঠিন বাস্তবতা এই চেতনাকে সঠিক গতিপথে স্থাপন করে। আসলে চড়াই উতরাই পেরিয়ে সবকিছুর গতিই পূর্ণতার দিকে। সোমেন তাঁর শিল্পসৃষ্টির সময়টাতে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন বৃটিশ রাজত্বের উচ্ছেদের লড়াইয়ে বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত কিশোর ও তরুণরা সম্পৃক্ত হচ্ছে। বিষয়টি তাঁকেও উদ্বোদ্ধ করেছিলো। কিশোর-কিশোরীরা, তরুণ-তরুণীরা এক সময় সন্ত্রাসবাদের ভুল পথে ছিলো। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তারা তা পরিহার করে সাম্যবাদীদের নেতৃত্বে গণবিপ্লবের পথকে বেছে নিতে শুরু করে। সোমেনও এ পথ বেছে নেন। বিজ্ঞাসম্মত এই পথটি তরুণদের কাছে আলো-ছায়ার মতো ছিলো। এই পথে তাদের অন্তর বিশেষভাবে সাজানো ছিলো। সোমেন চন্দ তাদের এ অন্তরকে গভীর মমতা দিয়ে সহানুভূতির সাথে ছুঁতে পেরেছিলেন। এখানে নর-নারীর প্রেমের একটা প্রাধান্য ছিলো। সোমেন চন্দ বিষয়টা মেনে নিয়েছিলেন। এর দৃষ্টান্ত ‘একটি রাত’ গল্পটি। ‘বনস্পতি’ গল্পেও তিনি প্রেমকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। প্রত্যেক সৃষ্টির মূলে যেমন কিছু উপাদান কাজ করে তেমনি সোমেনের গল্পসৃষ্টিতে মূল উপাদান হচ্ছে প্রেম এবং সেটা শিল্পের প্রয়োজনে। তাঁর গল্পে তিনি দ্বান্দ্বিকভাবে প্রেমের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। সে প্রেম কিছুটা সাধারণ ও কিছুটা অসাধারণ, কখনো চাপা কখনো প্রকাশ, কোনো সময় বহির্মুখী আবার কখনো অন্তর্মুখী এমনই বৈশিষ্ট্যের। তবে সব পরিস্থিতিতেই এ প্রেমের গতি জীবনের বিকাশের দিকে। সোমেনের গল্পের পাত্র-পাত্রীরা হয়তো সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু প্রেম এদের কাউকে জীবনের অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়নি। গণজীবনশিল্পী হিসেবে এখানেই সোমেনের স্বার্থকতা।
ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলো সোমেন চন্দের অন্যতম আদর্শ। সম্প্রদায়তো থাকতেই পারে তবে মানুষকে সবসময় থাকতে হবে সব সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, এটাই ছিলো তাঁর বিশ্বাস। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর কাছে মানুষই ছিলো মুখ্য। তাঁর সময়ে ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে। এতে তিনি গভীরভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন, ভাবতে থাকেন স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য প্রস্তুত লোকগুলো নাকি আবার সাম্প্রদায়িকতার এই পঙ্কিলতায় ডুবে যায়! এই উদ্বেগ থেকেই তিনি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে শহরময় সাইকেলে চড়ে ঘোরা শুরু করেন। সোমেন চন্দ সব সময় তাঁর গল্পের কাহিনী জীবনের বাস্তবতা থেকে চয়ন করতেন। দাঙ্গার এই পরিবেশ থেকেই তাঁর ‘দাঙ্গা’ গল্পের সৃষ্টি। এই গল্পের নায়ককেও দেখা যায় সাইকেলে চড়ে সারা শহরে ঘুরছে। সোমেনের গল্প লেখার মূলে ছিলো তার অর্জিত জীবন সংক্রান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা যার ওপর তিনি তাঁর তুলির কাজ করতেন, তখন সেটি হয়ে ওঠতো এক নতুন বাস্তব।
জগতের কোনো কিছুই কোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন না। বিশেষ ও সাধারণের নিগূঢ় সম্পর্কই দ্বান্দ্বিকতা। সোমেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এ সম্পর্কিত গল্পগুলো বিশেষ, এছাড়াও কিছু গল্প আছে সাধারণ। যেমন- ‘সত্যবতীর বিদায়’ গল্পটি। বিশেষ গল্পগুলোতে মেহনতি মানুষের প্রতি সোমেনের অন্তরের দরদ উতলে ওঠেছে। সাধারণ গল্প এ থেকে বাদ পড়েনি। এ দুয়ের মাঝে সেতুবন্ধ হচ্ছে মানবতা। গণমানুষের শিল্পী সোমেন চন্দ মানবতা দিয়েই বিশেষ ও সাধারণকে মিলিয়েছেন, এখানে তিনি অনন্যসাধারণ।
সোমেন চন্দ ছিলেন বিপ্লবী। তবে তিনি তাঁর চিন্তা গল্পগুলোর চরিত্রে চাপিয়ে দেননি, আরোপ করেননি। তিনি লড়াইয়ের মাঠে চলতে গিয়ে গণমানুষের বাইরের ও ভেতরের জীবনরূপের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেগুলোই তিনি তার গল্পে দ্বান্দ্বিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে প্রকৃতির বাস্তব, তাঁর তুলির ছোঁয়ায় নতুন শিল্পময় বাস্তবে রূপ নেয়, যা পাঠকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এ দিক থেকে সোমেন চন্দ বাংলা সাহিত্যে সাম্য-বাস্তবতার একজন শক্তিশালী পথনির্দেশক।
পরিশেষে একটা কথা সামনে এসে পড়ে এমন একজন বাস্তবধর্মী শিল্পীর হৃদয়-বাসনা দীর্ঘ সময়ে এমন কি একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত ভূখণ্ডে বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ খুঁজতে হবে অনেক গভীরে। আমরা যদি মাও এবং হো চি মিনের দেশের দিকে দৃষ্টি দিই দেখতে পাবো তাঁরা তাঁদের সে সময়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্তব্য দ্বান্দ্বিকভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন যে কাজ আমাদের মুক্তির ঝান্ডা বহনকারীরা পারেন নি। আমাদের সমাজে এর জের এখনো চলছে। এদিক বিবেচনায় আমাদের এখন নতুন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সোমেন-সুকান্ত-মানিকের স্বপ্নকে বিন্যস্ত করতে হবে গণমুক্তির পথপরিক্রমায়।