আজ রবিবার ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম:
ময়মনসিংহ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীক নিয়ে আশরাফ তুঙ্গে ওমরা হজ্জে নেয়ার প্রলোভনে,প্রতারনা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার ২ তারাকান্দায় দু’মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত-১ মে দিবসে গৌরীপুরে ডেকোরেটর কারিগর শ্রমিক ইউনিয়নের বর্ণিল শোভাযাত্রা মহান মে দিবসে রাজ ওস্তাগার নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে গৌরীপুরে বর্ণিল শোভাযাত্রা বিশ্ব শ্রমিক দিবসে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে গৌরীপুরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা মহান মে দিবসে গৌরীপুরে জাতীয় শ্রমিক লীগের বর্ণিল শোভাযাত্রা অতি বাম আর অতি ডান মিলে সরকার উৎখাতে কাজ করছে: শেখ হাসিনা কৃষিবিদ ড. সামীউল আলম লিটনের আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী গৌরীপুরে বিশ্ব নৃত্য দিবস পালিত
||
  • প্রকাশিত সময় : জুন, ৫, ২০২০, ১:৩৪ অপরাহ্ণ




ডিস এন্টেনা এবং ভোরের আলো : লুৎফর রহমান

আনারকলি শ্বশুর বাড়িতে প্রথম রাতটি কাটিয়েছিলো স্বামির আপনজনদের সাথে । প্রথম ভোরে তার ঘুম ভেঙ্গেছিলো এক সুরেলা কণ্ঠের আযানে । সুরের প্রতি তার আজন্ম দুর্বলতা । পালা গান, বাউল গান, কির্তন ওসব সে কতো শুনেছে । সময়ের স্রোতে অনেক কিছু এখন ভাটিতে । গ্রামে ডিস এন্টেনা ঢুকে পড়েছে, রেডিওর স্থান দখলে নিয়েছে টিভি, মোবাইল । প্রায় রাস্তা পাকা হয়েছে, কুপিবাতি সরিয়ে জায়গা দখল করেছে সৌরবিদ্যুৎ, পল্লীবিদ্যুৎ ।এখন মোবাইল যুগ চলছে বলা যায় । আনারকলির স্বামীর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো মোবাইলেরই বদৌলতে । সে অনেক কথা ।

আনারকলির ভাই ক্ষুদ্র কৃষক যার সংসার ছিলো অভাবের । শৈশবে আনারকলি হারিয়েছিলো মা-বাপকে । ফলে ভাবির পরামর্শে ভাই তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয় কিছুটা বোঝা কমানোর লক্ষ্যে । বলা যায় তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে বস্তায় পুরে শ্বশুরবাড়ি চালান দেয়া হয় । আনারকলি কম সময়ের মধ্যেই দুই সন্তানের মা হয়ে যায় । অর্থাৎ সংসার তাকে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে ।এসব ক্ষেত্রে সে কখনো নিজের মতামত দেয়নি । কারণ ভাই-ভাবির সংসারে অবহেলা আর তাচ্ছিল্লের নিগড়ে বাঁধা পড়ে সবকিছু মেনে নেয়ার অভ্যেস তার গড়ে ওঠেছিলো ।

শ্বশুরবাড়িতে দ্বিতীয় দিন হয় বাসর । ওসব সে বোঝতো না । বড় জা তাকে ধরে ধরে বাসর ঘরে নিয়ে গিয়েছিলো । পালঙ্কটি ছিলো ফুল আর জরি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো । ওর মনে একটা অজানা ভীতি কাজ করছিলো । বাসর ঘরেই সে স্বামী নামক বস্তুটিকে প্রথম দেখে । মনের গভীরে একান্তে আঁকা চিত্রটির সাথে মিলে না । লোকটা বয়সে ভাইয়ের চেয়েও বড় হবে । খুব কাছে এলে মনে হলো ওর শ্বাসের গণ্ডগোল আছে ।

সময় এগুতে থাকলো । একসময় আনারকলি জানতে পারলো আব্দুল আলিম নামক স্কুল শিক্ষক স্বামীটি আরো একটি বিয়ে করেছিলো । টেকেনি । বউ ছেড়ে গিয়েছিলো । বড় ঝা-র কাছে এর রহস্য জানতে চাইলে তিনি শুধু হাসেন । তারপর অভিজ্ঞতা দিয়ে আনারকলিকে তা বোঝতে হয় ।

আলিম আনারকলিকে বেশ আদর যত্ন করতে শুরু করলো । পুতুলের মতো সোনাদানা কাপড়চোপড়ে সাজালো । না চাইতেই সব এনে দিতে লাগলো । ওকে অভিলাষের এক নতুন স্রোতে ভাসাতে চাইলো যেনো । আলিম ছিলো এলাকার প্রসিদ্ধ জন তাছাড়া ভালো বিত্তেরও মালিক । আনারকলির মনে হলো সে যেন সুখি হয়ে ওঠছে । মনের ভেতর আনন্দ-ঢেউ বইতে লাগলো । মনে হলো অনেক কিছু পেয়ে গেছে । শ্বশুরবাড়ি তার কাছে ভালো লাগতে শুরু করলো ।

তবে কিছুদিন যেতে না যেতে দেহ-মনে একটা নতুন বিষয় অনুভূত হতে শুরু করলো । শরীরে একটা সরীসৃপের অস্তিত্ব পরিষ্কার অনুভব করতে লাগলো সে । মনে হতে থাকলো সারাক্ষণ সরীসৃপটা ওকে প্যাঁচিয়ে রাখছে । ওটা বড় বেয়াড়া, স্বৈরাচারী, নীল দংশনকারী । আলিম ওখানে যোগ্য বিবেচিত হলো না । এমন না হলে আনারকলি বেশ ভালোই ছিলো । অস্থির হয়ে ভাবে সে, এখন কী করবে ।

অনেককিছু মিলিয়ে আলিম মানসিকভাবে কেমন যেনো দুর্বল হয়ে পড়ে যদিও তার বিরুদ্ধে আনারকলির কোন প্রকাশ্য অভিযোগ ছিলো না । এখানে এসে সেতো মা হতে পেরেছে, একটা সুন্দর সংসার পেয়েছে, কর্তৃত্ব হয়েছে তার । এসবের জন্য আলিমইতো দায়ি । কিন্তু আলিমের হিসেব অন্যখানে । আলিম ক্রমশ বোঝতে থাকে তার পৃথিবী সবদিক থেকে যেনো ছোট হয়ে আসছে ।

একদিন আলিম বাড়িতে মেহমান নিয়ে আসে । মানুষটা গৌরবর্ণ, ঘাড় অব্দি লম্বা চুল, মাথায় কারুকাজ করা গোল টুপি আর চাপদাড়ি মিজমিজে কালো । তার সাদা আচকান-পাজামায় ঢাকা সুঠাম শরীর থেকে আতরের খোশবু ছড়াচ্ছে । আলিম আনারকলিকে বলে, চিনতে পেরেছো ? তোমাদের প্রতিবেশি, জালাল মৌলানা, তুমি যার আযানের ভক্ত । অতিথিকে চা-নাস্তা দিয়ে যত্ন করলো আনারকলি । টুকটাক আলাপও হলো, পরিকে চেনেন ? চিনি, আমার চাচাতো বোন -মৌলানা উত্তরে বললো । এর পর থেকে জালাল মৌলানা কারণে-অকারণে আলিমের বাড়িতে আসতে থাকে । ঘন ঘন আসে আলিমের মৃত্যুর আগে আগে ।

আনারকলি অনেক ক্ষেত্রে সবুর করতে চায়নি । করতে হয়েছে বাচ্চা দুটোর জন্য । এরাই তার জীবনের শৃঙ্খলার কারণ । আলিমকে ছাড় দেয়ার উপলক্ষ্য । কিন্তু পিপাসা থেকেই যায় । দক্ষিণের জানালা খোললেই দরিয়ার গর্জন শুনতে পেতো সে । অন্তর ছিলো চৈতের খরাসদৃশ যেখানে একটুখানি বৃষ্টির কামনা জড়িয়ে ছিলো । একতারাটায় সুর তোলে হারিয়ে যাওয়ার প্রচণ্ড বাসনা লুকিয়েছিলো ।

হাওয়ায় একটা কানাঘুষা ভেসে বেড়াচ্ছিলো, আলিমের মৃত্যু আনারকলির মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া করেনি । আসলে ঘটনাটা আনারকলিকে এক রকমের মুক্তি দিয়েছিলো । মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি কিন্তু আনারকলিতো বেঁচে আছে । এটা মানুষ বোঝবে কেনো, বোঝে মানুষের কী লাভ ।

আলিমের মৃত্যুর পর যথেষ্ট সময় কেটে গেলো । মন-শরীর-সন্তান আনারকলির ভাবনাকে আঁকড়ে ধরলো । সব গুলমেলে ঠেকতে থাকলো । মন বললো, বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে সময় পার করে দে । শরীর বিদ্রোহ করে । প্রচণ্ড দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আনারকলি । কোন সমাধান খোঁজে পায় না । সে মা । সন্তানদের রক্ষা করা তার পবিত্র দায়িত্ব । এর অর্থ সে কি নিজেকে ঠকাবে ? কেনো ? ভাবতে ভাবতেই এশার আযান পড়ে যায় । বাতাসে ভেসে আসে জালাল মৌলানার সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ । সে অযু করে নামাজ আদায় করে । জায়নামাজে বসেই ভাবে এই মানুষটাকে কি নেয়া যায় না ? যাবেনা কেনো ? নদী কি সাগরে মিশবে না ? আনারকলির ভাবনার সুতো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে যায় । আবার জোড়া লাগাতে চেষ্টা করে । ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে তার । সে দৃঢ় হতে চায় । সমস্ত অতীত বোঁচকায় পুরে গিট্টু দেয়, বর্তমানই সত্য । বর্তমানের বুকে পা রেখে সে আগামীর দরজা খুলবে । অনেকক্ষণ ভাবে সে এবং একটা পরিকল্পনার নকশা আঁকে । ছেলেকে ডেকে বলে, মৌলানাকে দাওয়াত কর মলুদ পড়াবো ।

বসরাই আতরের ভুরভুর গন্ধ ছড়িয়ে জালাল মৌলানার আগমন হলো । লোবান-আগরবাতি-গোলাপজলের খোসবু ঘরময় । আনারকলির মনে নাচের তরঙ্গ । সে ভালো করে সাজগোজ করলো । মৌলানার সাথে বারবার তার চোখের মিলন হতে থাকলো । মৌলানা একবার হেসে ওঠলো । এই সামান্য হাসি আনারকলিকে ইঙ্গিত দিলো যে মৌলানার রহস্য-দরজা খুলে গেছে । সে শক্তি সঞ্চয় করলো নিজেকে প্রকাশ করতে কিন্তু ব্যর্থ হলো । রাজ্যের সকল লজ্জা একসাথে ওকে ধাওয়া করলো । আওলে গেলো সাজানো কথাগুলো । আর এদিকে মৌলানা পুনরায় একচিলতে হেসে বিদেয় নিলো । আনারকলি যেনো কোন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে গেলো ।

আনারকলি নিজেকে তিরস্কার করতে থাকলো । ধিক্কার দিলো । মনে মনে বললো, প্রকাশের এ দীনতা কেনো ? নদী কি কখনো ভাবে কুল উপচালে কার কী হবে ? প্রলয়ের কথা ভেবে কি কালবৈশাখী ঝড় থেমে যায় ? নামাজ আদায় করে সে বড় জা-র কাছে যায় । তিনি তাকে খুব স্নেহ করেন । তাঁর কাছে আনারকলি মনের কথাটা বলতে চায় কিন্তু বলতে গিয়ে খোলসা করতে পারে না । জা বলেন, আমতা আমতা করতাচ ক্যান, কী বলতা চাও পষ্ট কইরা কও । আমি আপা বিয়া করতে চাই, আনারকলি বলে । জা বলেন, ও এই কথা, বিধবাতো আমিও, আমার লাগি দেহ একখান । না আপা হাইসেন না, ঠাট্টা না, আমি জালাল মৌলানাকে বিয়া করতে চাই, বলে আনারকলি, আপনে আমারে সাহায্য করইন আপা ।

বড় জা এমন কথা শোনে থ খেয়ে যান । কিছু সময় নীরব থেকে বলে ওঠেন, তোমার কি মাথা খারাপ অইছে ? তোমার দুটো বাচ্চা আছে, মৌলানা বিদেশি মানুষ, মসজিদের ইমাম, লোকে বলবে কী ? আনারকলি দৃঢ় কণ্ঠে বললো, মৌলানা আমার দেশি, পরিচিত, আলিমের বন্ধু ও একজন খাঁটি খোদাভক্ত মানুষ । সে বাড়িতে থাকবো, বাচ্চাগোরে বাপের আদর দিবো এতে দোষের কী ? গাঁয়ের মড়ল মহব্বত আলি বিবি মরলে চল্লিশ দিন পার না অইতেই পাঁচ সন্তানের বাপ অইয়াও জোয়ান চেরি বিয়া করলাইন, কেউতো দুষের কইলো না । আনারকলির এই কথা শোনে বড় জা রেগে বললেন, দেহ, হগ্গল সময় হগ্গল তমিসিল খাটে না ।

বড় আপা আনারকলির কোন যুক্তি মানতে রাজি না । তিনি গোপনে তার ভাইকে খবর পাঠালেন । ভাই এসে আনারকলির ওপর এইভাবে রাগ ঝাড়লো, বেসবুর মেয়া তুই আমগো হগ্গলের মুখ পুড়াইবার লাগচস । উত্তরে সে বললো, ভাইজান অহনতো বড় ভাইরা অচি অইয়া বিধবা বইনদের বিয়া দেয় আর আপনে কইতাচইন মুখ পুড়াইচি । আমিতো অন্যায় কিচু কই নাই, বিয়ার কথাইতো কইচি, আলিম থাকতেতো কই নাই । এবার ভাই বোনের দিকে তেড়ে এলো মারতে । এতে আনারকলি নতুন একটি সত্যের মুখোমুখি হলো, এই মানুষটাকে সহোদর মনে হলো না, একজন অচেনা পুরুষ মনে হলো ।

বড় জা হাল ছাড়েননি । তিনি আনারকলিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এইসব পাপ চিন্তা । এগুলাইন চাইরা দাও । আনারকলি বলে, আপা আমি পাপচিন্তা করি নাই, মৌলানারে আনচিলো আপনের দেউরে , আমিতো নিজেরে নিষ্পাপ রাখচি । শুনে বড় আপা আঁৎকে ওঠেন, কও কী ! হ আপা, আনারকলি কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, মৌলানা অহন স্বপ্নে রাইতে আইয়া আমারে জড়ায়া লয়, আমি আপা কব্বরের আজাবে আচি । আপা আপনে মেয়া মানুষ আমার মায়ের লাহান, আমারে বাচাইন ।

বড় আপার দুশ্চিন্তা অন্যত্র । মৌলানা এ বাড়িতে জামাই হয়ে এলে আলিমের সবকিছুর ওপর তদারকির একটা অধিকার পেয়ে যায় । এতে তার নিজের ছেলেরা বাদ পড়ে । সুতরাং যে কোন মূল্যে বিয়েটা আটকে দিতে হবে । তিনি আনারকলির বিরোদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন । জালাল মৌলানার সাথে তার অবৈধ সম্পর্কের কাহিনী সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে দেন । মিথ্যার এই বদ হাওয়ার বিরোদ্ধে কেউ দাঁড়ায় না । সবাই যেনো একটা মজা পেয়ে যায় । সমাজপতিরা সমাজকে রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগে পড়েন । দরবার ডাকা হয় । সিদ্ধান্ত হয়, এমন বেদাত পুরুষকে আল্লাহ্র ঘরের হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া যায় না । তারপর বর্তমান শতাব্দীর একদল টগবগে তরুণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় । তাদের কেউ জালাল উদ্দিন মৌলানার দাড়ি আবার কেউ বাবরি ধরে মুন্সিবাড়ির মসজিদ থেকে টেনে-হেঁচড়ে বের করে বাক্সপেটেরাসহ বাসে তুলে দেয় । ফলে গ্রাম, সমাজ আর মসজিদের পবিত্রতা এবারের মতো রক্ষা পেয়ে যায় ।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১