আজ বৃহস্পতিবার ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

||
  • প্রকাশিত সময় : জুন, ৫, ২০২০, ১:৩৪ অপরাহ্ণ




ডিস এন্টেনা এবং ভোরের আলো : লুৎফর রহমান

আনারকলি শ্বশুর বাড়িতে প্রথম রাতটি কাটিয়েছিলো স্বামির আপনজনদের সাথে । প্রথম ভোরে তার ঘুম ভেঙ্গেছিলো এক সুরেলা কণ্ঠের আযানে । সুরের প্রতি তার আজন্ম দুর্বলতা । পালা গান, বাউল গান, কির্তন ওসব সে কতো শুনেছে । সময়ের স্রোতে অনেক কিছু এখন ভাটিতে । গ্রামে ডিস এন্টেনা ঢুকে পড়েছে, রেডিওর স্থান দখলে নিয়েছে টিভি, মোবাইল । প্রায় রাস্তা পাকা হয়েছে, কুপিবাতি সরিয়ে জায়গা দখল করেছে সৌরবিদ্যুৎ, পল্লীবিদ্যুৎ ।এখন মোবাইল যুগ চলছে বলা যায় । আনারকলির স্বামীর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো মোবাইলেরই বদৌলতে । সে অনেক কথা ।

আনারকলির ভাই ক্ষুদ্র কৃষক যার সংসার ছিলো অভাবের । শৈশবে আনারকলি হারিয়েছিলো মা-বাপকে । ফলে ভাবির পরামর্শে ভাই তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয় কিছুটা বোঝা কমানোর লক্ষ্যে । বলা যায় তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে বস্তায় পুরে শ্বশুরবাড়ি চালান দেয়া হয় । আনারকলি কম সময়ের মধ্যেই দুই সন্তানের মা হয়ে যায় । অর্থাৎ সংসার তাকে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে ।এসব ক্ষেত্রে সে কখনো নিজের মতামত দেয়নি । কারণ ভাই-ভাবির সংসারে অবহেলা আর তাচ্ছিল্লের নিগড়ে বাঁধা পড়ে সবকিছু মেনে নেয়ার অভ্যেস তার গড়ে ওঠেছিলো ।

শ্বশুরবাড়িতে দ্বিতীয় দিন হয় বাসর । ওসব সে বোঝতো না । বড় জা তাকে ধরে ধরে বাসর ঘরে নিয়ে গিয়েছিলো । পালঙ্কটি ছিলো ফুল আর জরি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো । ওর মনে একটা অজানা ভীতি কাজ করছিলো । বাসর ঘরেই সে স্বামী নামক বস্তুটিকে প্রথম দেখে । মনের গভীরে একান্তে আঁকা চিত্রটির সাথে মিলে না । লোকটা বয়সে ভাইয়ের চেয়েও বড় হবে । খুব কাছে এলে মনে হলো ওর শ্বাসের গণ্ডগোল আছে ।

সময় এগুতে থাকলো । একসময় আনারকলি জানতে পারলো আব্দুল আলিম নামক স্কুল শিক্ষক স্বামীটি আরো একটি বিয়ে করেছিলো । টেকেনি । বউ ছেড়ে গিয়েছিলো । বড় ঝা-র কাছে এর রহস্য জানতে চাইলে তিনি শুধু হাসেন । তারপর অভিজ্ঞতা দিয়ে আনারকলিকে তা বোঝতে হয় ।

আলিম আনারকলিকে বেশ আদর যত্ন করতে শুরু করলো । পুতুলের মতো সোনাদানা কাপড়চোপড়ে সাজালো । না চাইতেই সব এনে দিতে লাগলো । ওকে অভিলাষের এক নতুন স্রোতে ভাসাতে চাইলো যেনো । আলিম ছিলো এলাকার প্রসিদ্ধ জন তাছাড়া ভালো বিত্তেরও মালিক । আনারকলির মনে হলো সে যেন সুখি হয়ে ওঠছে । মনের ভেতর আনন্দ-ঢেউ বইতে লাগলো । মনে হলো অনেক কিছু পেয়ে গেছে । শ্বশুরবাড়ি তার কাছে ভালো লাগতে শুরু করলো ।

তবে কিছুদিন যেতে না যেতে দেহ-মনে একটা নতুন বিষয় অনুভূত হতে শুরু করলো । শরীরে একটা সরীসৃপের অস্তিত্ব পরিষ্কার অনুভব করতে লাগলো সে । মনে হতে থাকলো সারাক্ষণ সরীসৃপটা ওকে প্যাঁচিয়ে রাখছে । ওটা বড় বেয়াড়া, স্বৈরাচারী, নীল দংশনকারী । আলিম ওখানে যোগ্য বিবেচিত হলো না । এমন না হলে আনারকলি বেশ ভালোই ছিলো । অস্থির হয়ে ভাবে সে, এখন কী করবে ।

অনেককিছু মিলিয়ে আলিম মানসিকভাবে কেমন যেনো দুর্বল হয়ে পড়ে যদিও তার বিরুদ্ধে আনারকলির কোন প্রকাশ্য অভিযোগ ছিলো না । এখানে এসে সেতো মা হতে পেরেছে, একটা সুন্দর সংসার পেয়েছে, কর্তৃত্ব হয়েছে তার । এসবের জন্য আলিমইতো দায়ি । কিন্তু আলিমের হিসেব অন্যখানে । আলিম ক্রমশ বোঝতে থাকে তার পৃথিবী সবদিক থেকে যেনো ছোট হয়ে আসছে ।

একদিন আলিম বাড়িতে মেহমান নিয়ে আসে । মানুষটা গৌরবর্ণ, ঘাড় অব্দি লম্বা চুল, মাথায় কারুকাজ করা গোল টুপি আর চাপদাড়ি মিজমিজে কালো । তার সাদা আচকান-পাজামায় ঢাকা সুঠাম শরীর থেকে আতরের খোশবু ছড়াচ্ছে । আলিম আনারকলিকে বলে, চিনতে পেরেছো ? তোমাদের প্রতিবেশি, জালাল মৌলানা, তুমি যার আযানের ভক্ত । অতিথিকে চা-নাস্তা দিয়ে যত্ন করলো আনারকলি । টুকটাক আলাপও হলো, পরিকে চেনেন ? চিনি, আমার চাচাতো বোন -মৌলানা উত্তরে বললো । এর পর থেকে জালাল মৌলানা কারণে-অকারণে আলিমের বাড়িতে আসতে থাকে । ঘন ঘন আসে আলিমের মৃত্যুর আগে আগে ।

আনারকলি অনেক ক্ষেত্রে সবুর করতে চায়নি । করতে হয়েছে বাচ্চা দুটোর জন্য । এরাই তার জীবনের শৃঙ্খলার কারণ । আলিমকে ছাড় দেয়ার উপলক্ষ্য । কিন্তু পিপাসা থেকেই যায় । দক্ষিণের জানালা খোললেই দরিয়ার গর্জন শুনতে পেতো সে । অন্তর ছিলো চৈতের খরাসদৃশ যেখানে একটুখানি বৃষ্টির কামনা জড়িয়ে ছিলো । একতারাটায় সুর তোলে হারিয়ে যাওয়ার প্রচণ্ড বাসনা লুকিয়েছিলো ।

হাওয়ায় একটা কানাঘুষা ভেসে বেড়াচ্ছিলো, আলিমের মৃত্যু আনারকলির মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া করেনি । আসলে ঘটনাটা আনারকলিকে এক রকমের মুক্তি দিয়েছিলো । মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি কিন্তু আনারকলিতো বেঁচে আছে । এটা মানুষ বোঝবে কেনো, বোঝে মানুষের কী লাভ ।

আলিমের মৃত্যুর পর যথেষ্ট সময় কেটে গেলো । মন-শরীর-সন্তান আনারকলির ভাবনাকে আঁকড়ে ধরলো । সব গুলমেলে ঠেকতে থাকলো । মন বললো, বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে সময় পার করে দে । শরীর বিদ্রোহ করে । প্রচণ্ড দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আনারকলি । কোন সমাধান খোঁজে পায় না । সে মা । সন্তানদের রক্ষা করা তার পবিত্র দায়িত্ব । এর অর্থ সে কি নিজেকে ঠকাবে ? কেনো ? ভাবতে ভাবতেই এশার আযান পড়ে যায় । বাতাসে ভেসে আসে জালাল মৌলানার সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ । সে অযু করে নামাজ আদায় করে । জায়নামাজে বসেই ভাবে এই মানুষটাকে কি নেয়া যায় না ? যাবেনা কেনো ? নদী কি সাগরে মিশবে না ? আনারকলির ভাবনার সুতো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে যায় । আবার জোড়া লাগাতে চেষ্টা করে । ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে তার । সে দৃঢ় হতে চায় । সমস্ত অতীত বোঁচকায় পুরে গিট্টু দেয়, বর্তমানই সত্য । বর্তমানের বুকে পা রেখে সে আগামীর দরজা খুলবে । অনেকক্ষণ ভাবে সে এবং একটা পরিকল্পনার নকশা আঁকে । ছেলেকে ডেকে বলে, মৌলানাকে দাওয়াত কর মলুদ পড়াবো ।

বসরাই আতরের ভুরভুর গন্ধ ছড়িয়ে জালাল মৌলানার আগমন হলো । লোবান-আগরবাতি-গোলাপজলের খোসবু ঘরময় । আনারকলির মনে নাচের তরঙ্গ । সে ভালো করে সাজগোজ করলো । মৌলানার সাথে বারবার তার চোখের মিলন হতে থাকলো । মৌলানা একবার হেসে ওঠলো । এই সামান্য হাসি আনারকলিকে ইঙ্গিত দিলো যে মৌলানার রহস্য-দরজা খুলে গেছে । সে শক্তি সঞ্চয় করলো নিজেকে প্রকাশ করতে কিন্তু ব্যর্থ হলো । রাজ্যের সকল লজ্জা একসাথে ওকে ধাওয়া করলো । আওলে গেলো সাজানো কথাগুলো । আর এদিকে মৌলানা পুনরায় একচিলতে হেসে বিদেয় নিলো । আনারকলি যেনো কোন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে গেলো ।

আনারকলি নিজেকে তিরস্কার করতে থাকলো । ধিক্কার দিলো । মনে মনে বললো, প্রকাশের এ দীনতা কেনো ? নদী কি কখনো ভাবে কুল উপচালে কার কী হবে ? প্রলয়ের কথা ভেবে কি কালবৈশাখী ঝড় থেমে যায় ? নামাজ আদায় করে সে বড় জা-র কাছে যায় । তিনি তাকে খুব স্নেহ করেন । তাঁর কাছে আনারকলি মনের কথাটা বলতে চায় কিন্তু বলতে গিয়ে খোলসা করতে পারে না । জা বলেন, আমতা আমতা করতাচ ক্যান, কী বলতা চাও পষ্ট কইরা কও । আমি আপা বিয়া করতে চাই, আনারকলি বলে । জা বলেন, ও এই কথা, বিধবাতো আমিও, আমার লাগি দেহ একখান । না আপা হাইসেন না, ঠাট্টা না, আমি জালাল মৌলানাকে বিয়া করতে চাই, বলে আনারকলি, আপনে আমারে সাহায্য করইন আপা ।

বড় জা এমন কথা শোনে থ খেয়ে যান । কিছু সময় নীরব থেকে বলে ওঠেন, তোমার কি মাথা খারাপ অইছে ? তোমার দুটো বাচ্চা আছে, মৌলানা বিদেশি মানুষ, মসজিদের ইমাম, লোকে বলবে কী ? আনারকলি দৃঢ় কণ্ঠে বললো, মৌলানা আমার দেশি, পরিচিত, আলিমের বন্ধু ও একজন খাঁটি খোদাভক্ত মানুষ । সে বাড়িতে থাকবো, বাচ্চাগোরে বাপের আদর দিবো এতে দোষের কী ? গাঁয়ের মড়ল মহব্বত আলি বিবি মরলে চল্লিশ দিন পার না অইতেই পাঁচ সন্তানের বাপ অইয়াও জোয়ান চেরি বিয়া করলাইন, কেউতো দুষের কইলো না । আনারকলির এই কথা শোনে বড় জা রেগে বললেন, দেহ, হগ্গল সময় হগ্গল তমিসিল খাটে না ।

বড় আপা আনারকলির কোন যুক্তি মানতে রাজি না । তিনি গোপনে তার ভাইকে খবর পাঠালেন । ভাই এসে আনারকলির ওপর এইভাবে রাগ ঝাড়লো, বেসবুর মেয়া তুই আমগো হগ্গলের মুখ পুড়াইবার লাগচস । উত্তরে সে বললো, ভাইজান অহনতো বড় ভাইরা অচি অইয়া বিধবা বইনদের বিয়া দেয় আর আপনে কইতাচইন মুখ পুড়াইচি । আমিতো অন্যায় কিচু কই নাই, বিয়ার কথাইতো কইচি, আলিম থাকতেতো কই নাই । এবার ভাই বোনের দিকে তেড়ে এলো মারতে । এতে আনারকলি নতুন একটি সত্যের মুখোমুখি হলো, এই মানুষটাকে সহোদর মনে হলো না, একজন অচেনা পুরুষ মনে হলো ।

বড় জা হাল ছাড়েননি । তিনি আনারকলিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এইসব পাপ চিন্তা । এগুলাইন চাইরা দাও । আনারকলি বলে, আপা আমি পাপচিন্তা করি নাই, মৌলানারে আনচিলো আপনের দেউরে , আমিতো নিজেরে নিষ্পাপ রাখচি । শুনে বড় আপা আঁৎকে ওঠেন, কও কী ! হ আপা, আনারকলি কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, মৌলানা অহন স্বপ্নে রাইতে আইয়া আমারে জড়ায়া লয়, আমি আপা কব্বরের আজাবে আচি । আপা আপনে মেয়া মানুষ আমার মায়ের লাহান, আমারে বাচাইন ।

বড় আপার দুশ্চিন্তা অন্যত্র । মৌলানা এ বাড়িতে জামাই হয়ে এলে আলিমের সবকিছুর ওপর তদারকির একটা অধিকার পেয়ে যায় । এতে তার নিজের ছেলেরা বাদ পড়ে । সুতরাং যে কোন মূল্যে বিয়েটা আটকে দিতে হবে । তিনি আনারকলির বিরোদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন । জালাল মৌলানার সাথে তার অবৈধ সম্পর্কের কাহিনী সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে দেন । মিথ্যার এই বদ হাওয়ার বিরোদ্ধে কেউ দাঁড়ায় না । সবাই যেনো একটা মজা পেয়ে যায় । সমাজপতিরা সমাজকে রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগে পড়েন । দরবার ডাকা হয় । সিদ্ধান্ত হয়, এমন বেদাত পুরুষকে আল্লাহ্র ঘরের হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া যায় না । তারপর বর্তমান শতাব্দীর একদল টগবগে তরুণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় । তাদের কেউ জালাল উদ্দিন মৌলানার দাড়ি আবার কেউ বাবরি ধরে মুন্সিবাড়ির মসজিদ থেকে টেনে-হেঁচড়ে বের করে বাক্সপেটেরাসহ বাসে তুলে দেয় । ফলে গ্রাম, সমাজ আর মসজিদের পবিত্রতা এবারের মতো রক্ষা পেয়ে যায় ।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০