প্রতীক নিতে এসে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে রবিকুল ইসলাম (৪০)। নিথর গৃহটি বাড়ির পাশে চৌকিতে শায়িত। এ প্রতিনিধি ছবি তুলতে গেলেই তেড়ে আসেন বয়োবৃদ্ধ মা সখিনা খাতুন। তিনি চিৎকার করে বলেন, এই তোমরা আমার সন্তানের শরীরে হাত দিবা না। কেউ ওর শরীরে ছুঁইবানা। আমার ছেলেটি ঘুমাচ্ছে। আমি ওর লাশ নিতে দিবো না। রেললাইনে মৃতের লাশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়ে যাবে এমন বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। এ আতঙ্ক থেকেই রবিকুলের মা যুগান্তর প্রতিনিধিকেও লাশের নিকটে যেতে বাঁধা দেন। শুধু তাই নয়; লাশ ধৌত করতে নিয়ে যাওয়ার সময়েও বাঁধা দেন তিনি।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর/২০২১) জামাল উদ্দিনের ফুটবল প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে অটোরিকশাযোগে বাড়ি ফেরার পথে শ্যামগঞ্জ রেলক্রসিং এলাকায় রবিকুল ইসলাম (৪০) ট্রেনে কাটাপড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনি গৌরীপুর উপজেলার সিধলা ইউনিয়নের পূর্বপুনরিয়া গ্রামের সুরুজ আলীর পুত্র। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার জানাযা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন হয়। নিশ্চিত করেন ফুটবল প্রতীকের প্রার্থী মো. জামাল উদ্দিন। তিনি জানান, দু’পা হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে লড়াই করছে মোখলেছ। তিনি তার জন্য সবার নিকট দোয়া প্রার্থনা করেছেন।
এদিকে মৃত্যুর পরেই বিক্ষুব্দ এলাকাবাসী গৌরীপুর-শ্যামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক, শ্যামগঞ্জ-জারিয়া ও নেত্রকোণা রেলপথ অবরোধ করেন। গেইটম্যান দেয়া, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মাঝে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিতে প্রায় ৩ঘন্টা অবরোধ ছিলো।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, ৪র্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মাঝে মঙ্গলবার প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতীক পেয়ে অটোরিকশা যোগে ভেঁপু বাজিয়ে বাড়ি ফেরার পথে শ্যামগঞ্জ রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাটিকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায় প্রায় ২০গজ দূরে। অটোরিকশায় থাকা ফুটবল প্রার্থীর কর্মী রবিকুল ইসলাম (৪০) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তাকে শ্যামগঞ্জ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মো. ওবায়দুল্লাহ মৃত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, দুর্ঘটনায় আরো ৪জন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে এবং একজনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। আহতরা হলেন একই গ্রামের তাহের উদ্দিনের ছেলে মুখলেছুর রহমান (১৮), হাসিম উদ্দিনের ছেলে জসিম উদ্দিন (২৫), হযরত আলীর ছেলে কিরন মিয়া (৩০), চাঁন মিয়ার ছেলে স্বপন মিয়া (৩২) ও কছম উদ্দিনের ছেলে সজিব (১৮)। তারা সবাই সিধলা ইউনিয়নের পূর্বপুনরিয়া গ্রামের বাসিন্দা।
প্রত্যক্ষদর্শী শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন অর রশিদ জানান, সিধলা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী জামাল উদ্দিনের সমর্থকরা মাত্রাতিরিক্ত বিকট শব্দে ভেঁপু বাঁশি বাজিয়ে বাড়ি ফিরছিলো। চারপাশের লোকজন চিৎকার করলেও তারা বাঁশির আওয়াজের কারণে ট্রেনের হুইসেলও শুনতে পায়নি কেউ। আমি দৌড়ে এসে অটোরিকশা থেকে কয়েকজনকে নামাতে পেরেছি। দু’পাশের তিন/চারটি অটোরিকশাকেও সিগন্যাল দিয়ে সরানো হয়। অটোরিকশা থেকে নামতে নামতেই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নওপাই গ্রামের আমিনুল ইসলাম জানান, হারুন স্যার এভাবে এগিয়ে না আসলে লাশের সিরিয়াল হয়ে যেতো।
শ্যামগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার হায়দার আলী জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা ৩৭মিনিটে শ্যামগঞ্জ রেলক্রসিংয়ের জারিয়া রেলপথে ঢাকাগ্রামী বলাকা কমিউটার এক্সপ্রেক্স ট্রেনের সাথে এ দূর্ঘটনাটি ঘটে। ট্রেনের চালক মো. সাইদুর রহমান ট্রেনটি থামাতে ইঞ্জিনে হার্টব্রেক করান। এতে ইঞ্জিনের সামান্য সমস্যাও দেখা দেয়। ত্রæটি সারিয়ে ট্রেনেটি শ্যামগঞ্জ স্টেশনে দুপুর ১টা ৫মিনিটে প্রবেশ করে। তিনি আরো জানান, ট্রেন দুর্ঘটনার পরপরেই এলাকাবাসী বিক্ষুব্দ হয়ে পড়েন। তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষনিক অস্থায়ীভিত্তিকে একজন গেইট প্রদান করা হয়েছে। এরপরে আন্দোলনকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করেন।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ খান আব্দুল হালিম সিদ্দিকী। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আন্দোলনকারীদের দাবী মেনে নেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে সড়কের অবরোধ প্রত্যাহার করান। গৌরীপুর রেলওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ কার্তিক চন্দ্র রায় জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ ও আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি।
হরিষে-বিষাদ : সিধলা ইউনিয়নের নির্বাচনকে ঘিরে আনন্দউৎসব মুর্হুতেই বিষাদে পরিণত হয়। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারপ্রার্থীরা নিহতের বাড়িতে ছুটে যান। ফুটবল প্রতীকের প্রার্থী মো. জামাল উদ্দিন জানান, তিনি আহতদের সঙ্গে হাসপাতালে রয়েছেন। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় প্রতীক পাওয়ার পর আনন্দমিছিল থমকে দাঁড়ায়। এরপরেই স্ব স্ব প্রার্থীরা তাদের শোভাযাত্রা, মিছিল ও প্রচারণা বন্ধ করে দেন।
এদিকে নিহতের বাড়িতে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন তার মা সখিনা খাতুন (৭০)। তিনি পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ শোনেই ফসলি জমিতে লুঠিয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে আসলেই দু’হাত তুলে বারবার তার সন্তানকে বুকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য স্বজনদের নিকট আকুতি জানান। স্বামীর জন্য আলু দিয়ে ডিম রান্না করে ছিলেন স্ত্রী হাসিনা খাতুন। বাড়ি ফিরে খাবেন স্ত্রীকে এ আশ^াসও দিয়ে এসেছিলেন। সেই খাওয়া আর হলো না। লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেন রবিকুল। এই স্মৃতি নিয়ে স্ত্রী আজাহারিতে স্বজনরা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। রবিকুলের ৪কন্যার মধ্যে প্রতিবন্ধী দু’কন্যা রুনা আক্তার ও সোমা আক্তার। ‘বাবাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি’ যেন আকাশেও মেঘ জমেছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে, পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
স্ত্রী হাসিনা খাতুন ডিম রান্না করছিলেন। তখন সকাল ৮টা ছুঁইছুঁই করে। মোস্তফা এসেছেন মিছিলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে ডাকলেন রবিকুলকে। স্ত্রী বারবার অনয়বিনয় করেছিলো, খেয়ে যাও, তবে তয় সইছিলো না রবিকুলের। তাই স্ত্রীকে বলেছিলো মেম্বারপ্রার্থী জামালকে এবারও পাস করাতে হবে, যাই গা, এসে খাবো। এই কথা বলতে বলতে সজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন তিনি। রবিকুল ইসলামের আর খাওয়া হলো না।