গৌরীপুর প্রতিনিধি ঃ
২১আগস্ট শালিহর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাকবাহিনী গৌরীপুর উপজেলার শালিহর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে গিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করেছিল ১৩জনকে এবং ধরে নিয়ে গিয়েছিল বিশিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসিমের পিতা ছাবেদ আলীকে। যিনি আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। স্বজনরা আজও খুঁজে ৭১’র সালে হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনকে। সেদিন অনেক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। যাদেরকে স্বাধীনতার ৪৭বছরেও পুনঃবাসিত করা হয়নি।
এই দিনে শহীদ হন মোহিনী কর, জ্ঞানেন্দ্র মোহন কর, যোগেশ চন্দ্র পণ্ডিত, নবর আলী, কিরদা সুন্দুরী, শচীন্দ্র চন্দ্র দাস, তারিনী মোহন দাস, খৈলাশ চন্দ্র দাস, শক্রোগ্ন দাস, রামেন্দ্র চন্দ্র দাস, কর মোহন সরকার, দেবেন্দ্রে চন্দ্র দাস, কামিনী মোহন দাস।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িঘর আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর জ্ঞানেন্দ্র মোহন করের ছেলে ডা: বাদল চন্দ্র কর সেখান থেকে পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবার দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে ডা: বাদল চন্দ্র কর তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ডা: বাদল চন্দ্র কর ২০১৪ সালে মারা যান। তার ছেলে অমল কান্তি কর বর্তমানে তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক।
১৯৭১’র সালের এই দিনে ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জগামী ট্রেন শালীহর গ্রামে এসে থেমে যায়। পাকবাহিনীর দু’টি প্লাটুন একটি দক্ষিণমুখী আরেকটি উত্তরমুখী যাত্রা করে। উত্তরে এসেই প্রথমে ছাবেদ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ রায় বাড়ীতে পাকবাহিনী প্রথম অগ্নি সংযোগ করে। এরপর শালীহর গ্রামের ৪০টি বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। বিসকা ঠাকুর বাড়ীর রেন্ট্রিগাছতলায় কোমড়ে দরি বেঁধে ৩শ মানুষকে আটক করে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। সেখানে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল এমন ১৩জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। শালীহর বধ্যভূমিতে গ্রামবাসীকে ডেকে এনে বন্ধুকের বাট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে চালানো হয় নির্যাতন। পাকবাহিনীর আক্রমণে পুরোগ্রামটি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। শহীদদের স্মরণে প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির এমপি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। নির্মাণকালীন সময়েই অনিয়ম পরবর্তীতে অযত্ন অবহেলা ও সংস্কার না করায় স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে যাচ্ছে।
এছাড়াও বোকাইনগর ইউনিয়নের অষ্টঘর গ্রামে থানা আ’লীগের সভাপতি মৃত জমসেদ আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মৃত আব্দুস ছালাম ফকির, হামিদ ভূইয়া, হেকিম ভূইয়াসহ শতাধিক ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। বেতান্দর গ্রামের মুসলেম উদ্দিন, আবু ছিদ্দিক, আবুল কালাম, জহর আলী, আঃ জব্বার, সুলতান মিয়া ও ভাদেরা গ্রামের মফিজ উদ্দিন, আঃ জলিল, আব্দুল হামিদ, আব্দুল আজিজসহ পুরোগ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। সহনাটী ইউনিয়নের বাঙ্গুরহাটী গ্রামের আব্দুল মুন্নাফ তালুকদারের বাড়িসহ হতিয়র পালপাড়া শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। মাওহা ইউনিয়নের ধেরুয়া কড়েহা গ্রামের ছৈয়দ আলীর বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনী রাজাকাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে রাজাকার ও পুলিশের ৮জন সদস্য নিহত হয়। এসব তথ্য নিশ্চিত করেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমাণ্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড ও যুগান্তর স্বজন সমাবেশ উদ্যোগে ২১ আগস্ট নানা কর্মসূচীতে দিবসটি পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমাণ্ডার আব্দুর রহিম জানান, শহীদদের স্মরণে বিশেষ প্রার্থনা, পুষ্পমাল্য অর্পণ ও আলোচনা সভা শালীহর বধ্যভূমি অনুষ্ঠিত হবে।