শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সড়ক দুর্ঘটনা চিত্রশিল্পীর শত স্বপ্নের মৃত্যু ও প্রিয় বন্ধু ওয়াসিম মিয়া

প্রকাশিত হয়েছে- বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০২১
||
  • প্রকাশিত সময় : জুন, ১০, ২০২১, ৪:৫৬ অপরাহ্ণ

মো. রইছ উদ্দিন :
শিল্পী’র তুলির আঁচড়-ই তো শিল্পী’র ভাবনা ফুটে উঠে। আমার তুলি যে দিকে যায়, আমি সেদিকেই মনের কথাগুলোকে ফুটিয়ে তুলি। হ্যাঁ, এভাবেই রঙয়ের মেলায় মেতেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী ওয়াসিম মিয়া। জীবনকে উপভোগ করতে হয়, জীবন আনন্দে, নূতনের এভাবেই জীবনকে নিয়ে ভাবতেন। বন্ধুদের হাঁসাতেন, বলতেন হাঁসতে না পারলে, মানুষ দম আটকে মারা যায়।
এমন এক হাঁসির ভান্ডার ছিলেন ওয়াসিম। যিনি ক্লাসের ফাঁকে বন্ধু-বান্ধবদের জমিয়ে আড্ডা দিতেন। বড় আড্ডাবাজও ছিলো সে। ও জানতে কিভাবে, বন্ধুদের হাঁসাতে হয়। কারও চুল, কারও চোখ বা পরিহিত কাপড়ের বর্ণনায় তিনি গল্প জুড়ে দিতেন। সেই মানুষটি আমার বন্ধু। গালি কাকে বলে; ও বুঝাতো!
মধুর শব্দ ভান্ডার আমরা আনন্দ পেতাম। অথচ সেই হাসির মানুষটি চলে গেলো। আজ ও আমাদের মাঝে কথায় কথায় তুই উদাহরণ। সত্যিই তুই, কেমন আছিস; বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। তুই এভাবে চলে যাওয়ার নয়, অভিমানী; এটাও শোভা পায় না। কেননা তুই কখনও অভিমান শিখসনি। তোর বুকভরা ভালোবাসা, হৃদয়ে এক অফুরন্ত সহ্যভান্ডার ছিলো।
তুইতো আমাদের বুঝাতে, কষ্টের পর সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকে। হয়তো তোর সুখও হাতছানি দিয়েছিলো। ভালোইতো ছিলে, সবারকে কাঁদিয়ে কেন চলি গেলি। হে আল্লাহ তাকে এইভাবে কেন নিয়ে গেলি; আজকের এই দিনে তোমার নিকট ফরিয়াদ করছি। হে আল্লাহ তাকে তুমি বেহেশতের সর্ব্বোচ্চ স্থানে আসীন করুন। আমীন।
ওয়াসিমের পুরো নাম ওয়াসিম মিয়া। বাড়ি নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার গৌরাকান্দা গ্রামে। বিয়ে করেছিলেন গৌরীপুর উপজেলার পৌর শহরের গাঁওগৌরীপুরে। সহধর্মিনী ছিলেন মাহমুদা খাতুন। দাম্পাত্য জীবনে এক সন্তানের জনক ছিলেন।
সে ১৯৯৭সনে মোহনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। গৌরীপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। প্রথমে থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। সেখানেই পরিচয় ঘটে আরেক বন্ধু রবিনের সাথে। রবিন অবশ্য পরে চলে যান পুর্বদাপুনিয়ায় এক বাসা লজিংয়ে। এরপর ওয়াসিমও তার প্রতিবেশী বাসায় লজিং থাকতো। কলেজ আর আমার প্রতিবেশী গ্রামে লজিং থাকায় ওদের সাথে ভালোই কাটছিলো দিনকাল। ওয়াসিম ১৯৯৯সনে এইচ.এস.সি করে। এরপর ২০০১ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে।
এরপর চাকুরীতে যোগ দেয়। কয়েকটি স্থান ঘুরে অবশেষে চাকুরি নেয় স্কয়ার ফার্মাসিক্যালে। ফেনী জেলায় প্রমোশনাল অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ২০১০সালের ১০জুন এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ওর হাসোজ্জ্বল প্রাণটা কেড়ে নেয়।
ভেঙ্গে যায় একটি মানুষের সঙ্গে থাকা পুরো পরিবারের স্বপ্ন! ওর স্বপ্নের মৃত্যুর সঙ্গে একটি পরিবারের প্রতিটি মুর্হূতে নানা স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। ছেলেটি আজকের বয়স সম্ভবত ১৮/২০বছর হবে। প্রায় ২বছর আগে দেখা হয়েছে ভাবীর। ওয়াসিমের সন্তানও ভালো আছে। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। জীবনের স্রোতে ওয়াসিমের স্মৃতিকে ধারণ করে.. জীবন সংগ্রামে বেঁচে আছেন। সন্তানের সামনে বারবার মনে হয়, তার বাবার স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। দোয়া করি, ওয়াসিমের ছেলেটি যেন আলোকিত মানুষ হয়। মেধা তালিকায়ও সে ভালো করেছে, জেনে আরো ভালো লেগেছে। বেঁচে থেকো বাবা, রইলো শুভ কামনা।
আমাদের মুঠোফোনে আর কোনদিন ওয়াসিমের সেই নাম্বার টু-টাং করে বেজে উঠবে না। ওই প্রান্ত থেকে মধুমাখা আশ্রাব্য কথা শুনবো না। যে কথা শোনার জন্য দলবেঁধে বসে থাকতাম, তোরই অপেক্ষায়। তুই চলে গেলি, রেখে গেলি জীবনের প্রতিটি মুর্হূতের স্মৃতিময় কিছু কথা। ভালো থাকিস বন্ধু, ভালো থাকিস।
সেই দুর্ঘটনা থেকে হয়তো আমরা কিছুই শিখতে পারিনি। কখনও ভাবেনি, কেন ওয়াসিম চলে গেলো। হয়তো ওয়াসিমের কোন দোষ ছিলো না। ঘাতক বাসটাই তাকে মেরে ফেলেছে। তারপরেও আমরা একটু সতর্ক হলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা এড়াতে পারতাম। গাড়ীতে উঠে প্রতিযোগিতা নয়, অভারটেকিং সাবধানে। কেননা, একটি মৃত্যু অসংখ্য মানুষের জন্য সারাজীবনের কান্নায় পরিণত হয়।
আসুন আমরা সচেতন হই, ওয়াসিম মিয়ার মতো আর কারও কখনও মৃত্যু দেখতে চাই না। এক সঙ্গে বলি ‘নিরাপদ সড়ক চাই-স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, গৌরীপুর উপজেলা শাখা।
দৈনিক যুগান্তর গৌরীপুর প্রতিনিধি  ০১৭১৮০৬৯২১০।