শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

স্মৃতির আরশিতে সাংবাদিক কাজী মোনায়েম– আজম জহিরুল ইসলাম

প্রকাশিত হয়েছে- শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : মে, ৮, ২০২০, ৮:১৬ অপরাহ্ণ

স্মরণীয়-বরণীয়…………………………………………………..
স্মৃতির আরশিতে সাংবাদিক কাজী মোনায়েম
আজম জহিরুল ইসলাম

সাংবাদিকতা জগতে একটি স্মরণীয় নাম কাজী এম, এ মোনায়েম। গত ২৪ এপ্রিল-২০২০ শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় এই প্রতিথযশা সাংবাদিক আমাদের অশ্রুজলে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে ব্যথিত, শোকাভিভূত। করোনাবিধ্বস্ত এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে আকস্মিকভাবে তিনি চলে যাবেন, এটা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।
কাজী মোনায়েম ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভীক সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী। সৎ-সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি কেনোদিন তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বা বিসর্জন দেননি। এককথায় অপ-সাংবাদিকতাকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন এবং এ থেকে দূরে থাকতেন। এছাড়া তাঁর ব্যক্তি জীবন ছিল খুবই সাদামাটা। নিরহংকার এই মানুষটির মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকতো। তিনি যে কোনো মানুষকে অতি সহজেই আপন করে নিতে পারতেন।
কাজী মোনায়েম গৌরীপুর কলেজে অধ্যয়নকালীন সাংবাদিকতার সাথে জড়িয়ে পড়েন। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলার দর্পণ’ পত্রিকা দিয়ে তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। তৎকালে অর্থাৎ সত্তর দশকে এই পত্রিকাটি ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে দারুণ জনপ্রিয়। এই সাপ্তাহিক পত্রিকার সুবাদে তিনি অত্রাঞ্চলে একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতীয় পত্রপত্রিকায়ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এর মধ্যে জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’ এ থানা প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। গৌরীপুর থানাসহ পার্শ্ববর্তী কেন্দুয়া, পূর্বধলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, ফুলপুর, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা থানাও ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের আওতাধীন। তিনি গৌরীপুর প্রেসকাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিসহ সাংবাদিক সমিতি, গৌরীপুর ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্বও নিষ্ঠার সাথে পালন করেন।
সত্তর ও আশির দশকে সাংবাদিকতা করা ছিল খুবই কঠিন বিষয়। এখনকার মতো তখনকার যুগে কম্পিউটার, মোবাইল, ফেক্স, ইমেইল, ফেসবুক, ইউটিউব, ক্যামেরা এসব প্রযুক্তি ছিল না। তখন পায়ে হেঁটে কিংবা বাইসাইকেল ও রিক্সার উপর নির্ভর করে খবর সংগ্রহ করতে হতো। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা প্রতিকূল পরিবেশ ডিঙিয়ে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা অফিসে প্রেরণ করতেন। তারপর সংগৃহীত সেই খবর হাতে লিখে স্ব স্ব পত্রিকা অফিসে পাঠাতেন। সেই খবরের চিঠি সংশ্লিষ্ট পত্রিকা অফিসে পৌঁছতে তিন/চার দিন বা তারও অধিক সময় লেগে যেতো। আজকের তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আমরা দিনের খবর দিনেই পেয়ে যাই। তখনকার যুগে খবর পেতে হলে এক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো।
গৌরীপুর থানা ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দশটি থানার খবর সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল কাজী মোনায়েমের উপর। তিনি কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বা বাইসাইকেলে চড়ে খবর সংগ্রহ করে পত্রিকা অফিসে প্রেরণ করতেন। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করেই তাঁকে খবরের পেছনে ছুটতে হতো। তখনকার দিনে এমনই এক দায়িত্বশীল ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন কাজী মোনায়েম। কলেজে পড়াশোনা, এরপর পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করে সাংবাদিকতা পেশাকেও আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন তিনি।

ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলাধীন মিরাকান্দার কাজীপাড়া গ্রামে বসবাসকারী কাজী মোনায়েমের পিতা ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সৈনিক কাজী আব্দুল হাই। মাতা সুফিয়া আক্তার খাতুন একজন গৃহিনী। বর্তমানে মা-বাবা দু’জনই মৃত। গৌরীপুর পৌরসভাস্থ কালীপুর মধ্যম তরফে বসবাসকারী কাজী মোনায়েম প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন সরযূবালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এরপর সরকারি আরকে উচ্চ বিদ্যালয়, গৌরীপুর সরকারি কলেজ এবং সর্বশেষ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫২ সালের ৯ জানুয়ারি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলাস্থ নানাবাড়িতে জন্ম নেয়া কাজী মোনায়েমের সহধর্মিনী নাজমুন নাহার, দুই পুত্র কাজী আতিকুল হক রাহাত, কাজী সানাউল হক রাজীব ও একমাত্র মেয়ে কাজী মনিরা হক পরমা।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী কাজী মোনায়েম সাংবাদিকতা জীবনে ১৯ বছর, শিক্ষকতায় ৩৪ বছর এবং বিএনসিসির দায়িত্বে ছিলেন ২২ বছর। তিনি প্রথমে ময়মনসিংহের ‘বাংলার দর্পণ’, পরে চট্টগ্রামের ‘দৈনিক দেশবাংলা’, খুলনার ‘দৈনিক পূর্বাঞ্চল’, ঢাকার ‘দৈনিক দেশবাংলা’ ও পরে ঢাকার ‘দৈনিক সংবাদ’ এ দাপটের সাথে সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। এরপর কলেজের চাকরি সরকারি হয়ে গেলে তিনি সাংবাদিকতা থেকে সরে দাঁড়ান।
তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ প্রেসকাবের এডহক কমিটির সদস্য, সুর্বণ বাংলা পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক, গৌরীপুর ও নান্দাইল প্রেসকাবের সম্মানিত সদস্য। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে। সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশের জন্য ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়।
কাজী মোনায়েম সাংবাদিকতায় বুনিয়াদী প্রশিক্ষণসহ ঢাকা নিয়েয়ারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ঢাকা নায়েমে দু’মাসব্যাপী বুনিয়াদী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ সপ্তাহের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি বিএনসিসিতে বাৎসরিক প্রশিক্ষণ, সেনাবাহিনীর সাথে শীতকালীন যৌথ মহড়া, প্রি-অ্যামপ্লামেন্ট ক্যাডার ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ, ক্যাপসুল, লিডারশিপ, কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ শিবিরসহ গুরুত্বপূর্ণ নানাবিধ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পুরস্কারে ভূষিত হন। দৈনিক সংবাদে থাকাকালীন ১৯৮৩ সালে গৌরীপুর উপজেলা পরিষদ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। দৈনিক যুগান্তর স্বজন সমাবেশ গৌরীপুর উপজেলা কর্তৃক সুরেশ কৈরী পদক, বীরাঙ্গনা সখিনা সিলভার পেন অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন সাংবাদিক কাজী মোনায়েম।
বিএনসিসিতে দায়িত্ব পালনকালে সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন, বিশ্বপরিবেশ দিবস, আর্তমানবতার সেবায় স্বেচ্ছায় রক্তদান, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা, শহরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, নকল প্রতিরোধ ও খারাপ ফলাফল অর্জন করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উদ্বুদ্ধকরণ, বিএনসিসিতে থাকাবস্থায় সোবাহিনীতে অর্ধশত ছাত্রের চাকরিপ্রাপ্তিতে সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেন। এছাড়া সন্ধানীতে একাধিকবার স্বেচ্ছায় রক্তদান, মরণোত্তর চক্ষুদান, সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করে প্রশংসিত হন।
সাংবাদিকতা পেশা ছাড়াও তিনি অনেক নামীদামী কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বাংলা কলেজ, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ, জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ, মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ, টাঙ্গাইল সরকারি সাদত কলেজ, কিশোরগঞ্জ সরকারি গুরুদয়াল কলেজ ও ওয়ালী নেওয়াজ কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজ। সর্বশেষ ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে অবসরগ্রহণ করে আবার লেখালেখি জগতে ফিরে আসেন। গৌরীপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক রাজগৌরীপুর পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় অতিথি লেখক হিসেবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখা মুদ্রিত হয়। এছাড়া ময়মনসিংহ ও গৌরীপুর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও স্মরণিকায় তাঁর প্রচুর লেখা যেমন- প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, কবিতা ইত্যাদি ছাপা হয়েছে।
কাজী মোনায়েম ২০১৫ সালে গৌরীপুরের জানা-অজানা কাহিনী নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘গৌরীপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কিংবদন্তী’ নামের মূল্যবান এই গ্রন্থটি সুধী পাঠক সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে গৌরীপুর সরকারি কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ বইটির ভূয়শী প্রশংসা করেন। ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক এই বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি আমাদের সার্বিক সহযোগিতা নিয়েছেন। বিশেষ করে আমি তাঁকে নিঃস্বার্থভাবে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। জীবিতাবস্থায় তিনি একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কাব্যগ্রন্থটির নাম ছিল ‘মেঘমালা।’ বইটির প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে অঙ্গসজ্জার কাজও আমি নিজে করে দিই। কিন্তু তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে বইটি তিনি ছাপার অক্ষরে দেখে যেতে পারেননি। এখন যদি তাঁর পরিবার বিশেষ করে ছেলেমেয়েরা যদি উদ্যোগ নেয় তাঁদের বাবার লেখা ‘মেঘমালা’ পাণ্ডুলিপিটি ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করবেন তাহলে প্রয়াতের শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। পরিশেষে কাজী মোনায়েমের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, সাপ্তাহিক রাজগৌরীপুর, ময়মনসিংহ। মুঠোফোন : ০১৭৫৯-৪৭৬২৫৩।