শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

স্বাধীনতাপদক প্রাপ্ত দস্যু বনহুরের লেখক রোমেনা আফাজকে নিয়ে নাতনী লিসা’র স্মৃতিময় দিনলিপি

প্রকাশিত হয়েছে- শনিবার, ১২ জুন, ২০২১
||
  • প্রকাশিত সময় : জুন, ১২, ২০২১, ১:১৪ অপরাহ্ণ

উম্মে ফাতিমা লিসা :

আজকের দিন ১২ জুন কিন্তু সন টা ছিলো ২০০৩। আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি। যদি শুধু আমি আমার কথা বলি তাহলে ভুল হবে। এদেশের অনেকর পছন্দের মানুষ ছিলো উনি। উনি ছিলেন দেশ বরেণ্য নারী লেখক রোমেনা আফাজ। আমার দাদী। আজ তাঁর ১৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮ টা বছর হলো কিন্তু মনেই হয় না সে নেই। আজও চোখ বন্ধ করলে কোকড়া চুলে চিকন বেনি, ফর্সা মুখে কালো মোটা ফ্রেম এর চশমা, মুখে পান, হাতে তজবি সদা হাস্য উজ্জ্বল মুখটা এখনো ভেসে উঠে। দাদীর তুলনা দাদী। আমার দেখা অন্যরকম একজন মানুষ। আমি নিজেকে খুখ ভাগ্যবান মনে করি আমার জন্ম থেকে দাদীর মৃত্যু পর্যন্ত
দাদীর সাথে সময় কাটাতে পেরেছি। আমার নাম লিসা কিন্তু দাদী আমাকে সবসময় “নিশো/নিশু” করে ডাকতেন। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই কাটতো দাদীর সাথে। বিছানায় বসে একদিকে গল্প করছে একদিন রান্না করছে একদিকে অনবরতো লিখে যাচ্ছে। কোনো বিরক্তি নামের কোনো কিছুই ছিলো না তার। দাদী যখন লিখতো তখন এক ধারছে লিখে যেত। লিখার সময় দাদীকে দেখলে মনে হতো মুখস্ত লিখছে। এতো হৈ চৈ এর মধ্যে লিখলেও কোনো সময় লেখা কাটা কাটতি কলতে দেখিনি এমনকি ফ্রেশ করেই লিখতেও দেখিনি। যা লিখেছে একবারই। এমন প্রতিভা আমি কখনোই দেখিনি। সময় পেলেই আমাদের কাজিনদের আড্ডা হতো দাদীর বিছানায় দাদীর কমড়ের পিছনে। তারপরও দাদী এক ধারছে লিখেই যেতো বিছানার উপর একটা ছোট টুলের উপর দোয়াত কালির পেন দিয়ে। আমাদের হৈ চৈ এ খবরের সময় দাদু বিরক্ত হয় চিৎকার করলেও দাদী দাদুকে থামিয়ে বলতো আমি লিখছি তাও বিরক্ত হচ্ছি না তাহলে তুমি কেনো হও? তখন হৈ চৈ আরো বাড়তো আর দাদু বলতো “দূরতারি ভালা”। খুব মজা পেতাম আমরা। শুধু কি তাই রাতে দাদীর ঘরে মেলা বসতো। ফ্যামিলি মেলা। একটা নিদিষ্ট সময়ে তার পুরো পরিবার একসাথে না হলে দাদীর যেন শান্তিই হতো না। ফ্যামিলির একজন কোন কারনে না এলে শুরু হতো তার ছটফটানি। এতোটা ভালোবাসা তো তার ফ্যামিলকে। একটা কমপ্লেক্স এ সাত ছেলে এক মেয়ের আলাদা আলাদা বাসা। কিন্তু বাহিরের কেউ বুঝবেনা আমর আলাদা। আলাদা হলেও সবসময় জয়েন্ট ফ্যামিলির মতো আমারা। আর এই বন্ধনটা দাদীর জন্য। সবাইকে সবসময় এক করে রাখতো। সারাটা দিন ব্যস্ত থাকতো এর মাঝেও গাছের চর্চা পানি দেওয়া নিজেই কলতো। এর মাঝেও দাদীর অসংখ্য ভক্তরা দাদীর সাথে দেখা করতে আসতো সময় অসময়ে। সবার সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বলতেন এবং তাদের সময় দিতেন। তা ছাড়াও সাংবাদিকরা তো ছিলোই। প্রতিদিন ১০/১২ টা করে ভক্তদের চিঠি আসতো। প্রতিটা চিঠির উওর দিতো দাদী। এমনকি দাদী যখন বেশি অসুস্থ হলো তখন সে বলতো আর আমি লিখতাম। পরে দাদী ঐ লিখাতে অটোগ্রাফ দিয়ে পোস্ট করতো সেই ঠিকানায়। মজার ব্যাপার হলো, দাদীর মাথায় কালো চুল বেশি ছিলো সাদা চুল খুব কম। ঐ সময় এক টাকা অনেক ছিলো আমাদের কাছে। তাই দাদীর ৫টা করে পাঁকা চুল তুলে এক টাকা করে কামাতাম কাজিনরা। অন্য রকম দিন ছিলো আমাদের। দাদী জীবনে অনেক বই লিখেছে অনেক পদক পেয়েছিলো কিন্তু দাদীর একটাই আফসোস ছিলো সরকারি পদক সে পেলোনা। আর হয়তো সেই আক্ষেপ থেকেই দাদী লিখেছিলো- জীবনকালে যে পেলো না মালা চিনিলো না যারে করি অবহেলা মৃত্যুর পরে কি হবে তার সুনাম! কি হবে আর তাঁহারে স্মরি! কি হবে আর স্মৃতিসৌধ গড়ি! প্রদীপ যদি নিভে যায় কি হবে তায় তৈল ভরে হায়! প্রতিভার ক্ষয় রোমেনা আফাজ অবশেষে দাদী সরকারি পদক পেলো কিন্তু মরোনাক্ত। বেঁচে থাকতে পেলে হয়তো তার মতো খুশী আর কেউ হতো না। তার কবিতার অক্ষরগুলো মিলে গিয়েছে। এতো আক্ষেপ নিয়েও দাদী সবসময় বলতো আমার স্বার্থকতা আমার পদক আমার ভক্তরা। দাদীকে এখনো অসম্ভব পরিমাণ মিস করি। আল্লাহ যেন দাদীকে বেহস্তবাসী করেন। সবাই আমার দাদীর জন্য দোয়া করবেন।

উম্মে ফাতিমা লিসা , রোমেনা আফাজের নাতনী, বগুড়া