শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সামগ্রিক দৃষ্টিতে নজরুল : লুৎফর রহমান

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ২৬ মে, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : মে, ২৬, ২০২০, ৯:১৯ অপরাহ্ণ

নজরুল কাব্যকে আধুনিকতার নামে প্রশ্নের মুখোমুখি করা হচ্ছে। ধর্মীয় গোঁড়ামির ফ্রেমে আটকাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে বিষয়টা কি তা-ই? বাংলা কাব্যের হাজার বছরের একটা প্রাণবন্ত ঐতিহ্য রয়েছে। এর সাথে তাল রেখে নজরুল কাব্যে স্থান পেয়েছে নতুন পৃথিবী, নতুন মানবসমাজের স্বপ্ন।

আজ নিখিলের বেদনা আর্ত পীড়িতের মাখি খুন,

লালে লাল হয়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ –

একেই বলে জনগণমুখী আধুনিক কবিতার ধারা। এই ধারায় নজরুল এক নতুন রবির তেজ।

কায়েমী স্বার্থবাদীরা নজরুল কাব্যের প্রচণ্ডতায় ভীত হয়ে একে থামিয়ে দেয়ার মানসে ধর্মীয় গোঁড়ামীর ফ্রেমে আটকাবার চেষ্টা করেছে। কারণ সমাজের পরিবর্তন এদের কাম্য নয়। কিন্তু আমাদেরকে নজরুলের কবিতাকে দেখতে হবে প্রাণের তাগিদ থেকে, ইতিহাসের তাগিদ থেকে। এ জন্য স্বার্থান্বেষী মহলের উঠানো বিতর্ককে মোকাবেলা করতে হবে ক্ষুরধার যুক্তির আলোকে।

এমন অনেকেই আছেন যারা গতিশীলতায় বিশ্বাসী তারাও হয়তো নজরুল কাব্যকে বোঝতে ভুল করেন। নজরুল কাব্যের একটা ধারাবাহিক সামগ্রিকতা রয়েছে। কিন্তু তাঁর কোরাস থেকে আলাদা করা হয় গজলকে, বিষের বাঁশীকে দোলন চাপা থেকে। বিদ্রোহীর পাশে মনে করা হয় পূজারিণী বেমানান। আসলে নজরুল প্রেম ও বিদ্রোহকে আলাদা করে দেখেননি । তিনি বলেছেন –

“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য;

নজরুলের গজল আর কোরাস একসূত্রে গাঁথা। প্রতিটি কবিতা, গান বা সৃষ্টি একটি গতিশীল সূত্রে বাঁধা। সমসাময়িক জীবন-স্রোত থেকে কবি এই সূত্রটি বাছাই করেছিলেন সমগ্র জীবনের সূত্র হিসেবে। কিন্তু এখন তাঁকে দেখা হচ্ছে এক খণ্ডিত দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দাবিদার হয়ে।

নজরুল কাব্যকে যারা ফ্রেমে বাঁধার চেষ্টা করেন তাঁরা সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তাঁরা নজরুলের কবিতা থেকে পুরাণকে বাদ দিতে চাইছেন। যেমন মুসলমানের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় গোরস্তানে, হিন্দুদের শ্মশানে । এঁরা নজরুল কাব্য থেকে মহাশ্মশান শব্দটি বাদ দিয়ে এর পরিবর্তে গোরস্তান রাখার চেষ্টা করেন। “বিদ্রোহী” কবিতা থেকে পুরানকে বাদ দেয়া কি সম্ভব? সম্ভব না, তাহলে যে এটি আর বিদ্রোহী থাকবে না। নজরুল কাব্যের প্রাণকেই হরণ করা হবে। তারপরেও যারা নজরুলের সৃষ্টি থেকে পৌরানিক শব্দ বাদ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা নজরুলকে বাদ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা বাঙালির সংস্কৃতিকে ভয় পান মানবিকতার প্রতিষ্ঠা চান না। নজরুল বাঙালির কবি, মানুষের কবি, জগতের কবি। জীবনের এই কবিকে দেখতে হবে এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

সাঁওতালদের ঝুমুর নাচ, লেটুর দল, যাত্রাপালার অভিনয় আর নজরুলের শৈশব এক সুতায় বাঁধা। অন্যদিকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি তাঁর কৈশোরকে ঘিরে ফেলেছিলো। তাঁর যৌবনকে প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে নাড়িয়ে দিয়েছিলো এক নতুন জামানা, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সে যুগ। রুশবিপ্লব দ্বারা আন্দোলিত সে যুগ তখনকার হাজার হাজার বছরের সমাজে এক ওলটপালটের হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলো, এবং নজরুলের মনোজগতেও। পল্লিসংস্কৃতি এবং এই নবযুগ নজরুলকে করেছিলো মুখপাত্র। তিনি শুধু জাতীয়তাবাদে আবদ্ধ থাকেননি আন্তর্জাতিকতাবাদের মুক্তস্রোতে অবগাহন করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব সমাজবাদের প্রভাতে চারণ কবি। ধূমকেতু, ফণীমনসা, অগ্নিবীণা আর বিষের বাঁশীতে স্থান পেয়েছে চিরবঞ্চিতের আত্মপ্রতিষ্ঠার বাণী। তাই সমাজ I ইতিহাসের সামগ্রিকতায় নজরুলকে বিচার করতে হবে। এখানে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানটি উল্লেখ করার মতো, তিনি নজরুলকে ডেকে বলেছিলেন-

“আয় চলে আয়রে ধুমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু।” নজরুলের মাঝে সেদিন জ্বলে ওঠেছিলো প্রাণ। সেটি সম্ভব হয়েছিলো তার কৈশোরের সঞ্চয় আর যৌবনের জাগ্রত সত্তার অভিজ্ঞতার মিশ্রণে। কবি কিশোর বয়সে ঝুমুর নাচ আয়ত্ব করেছিলেন প্রকৃতি থেকে। তিনিই আন্তর্জাতিক সংগীত রচনা করেছিলেন রুশ-বিপ্লবের প্রেরণা থেকে। নজরুলের ইসলামি সংগীত, শ্যামা সংগীত ও কীর্তনের উৎসও প্রকৃতি অর্থাৎ জীবন, এখানেও তিনি মানবিকতারই জয়গান করেছেন। সব এসেছে নজরুলের স্বভাবকবিত্ব থেকে। সেদিন নজরুল তাঁর সব দোষগুণ ছাপিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছিলেন ইতিহাসের। তাই চিরকাল ইতিহাসই নজরুলকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁকে খণ্ডিত করা সম্ভব না, ফ্রেমে বাঁধা সম্ভব না, তাঁর থেকে কিছু কেটে ফেলা সম্ভব না। এমনটা করা হলে নজরুলই বাদ পড়ে যাবেন। আমরা তা চাই না বা হতে দিতে পারি না।