বুধবার, ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা একটি সঠিক তালিকা মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই : বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: ইকবাল হাসান খান

প্রকাশিত হয়েছে- রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : নভেম্বর, ২২, ২০২০, ৫:৩৮ অপরাহ্ণ

প্রধান প্রতিবেদক :
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের অষ্টঘর (কোর্টবাড়ি) গ্রামের আব্দুল হামিদ খান ও আমেনা খাতুন দম্পত্তির পুত্র মো. ইকবাল হাসান খান। স্ত্রী সৈয়দা সুফিয়া বেগম। দুই পুত্র সন্তানের জনক। সন্তানদ্বয় হলেন মো. মামুনূর রশিদ ও মো: মেহেদী হাসান মিথুন। তিনি ১৯৭১’র সালের ৪ অক্টোবর লাল-সবুজের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার শপথ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সাংবাদিক মো. রইছ উদ্দিনের সঙ্গে তুলে ধরেন ৭১’র স্মৃতিময় দিনলিপি।

তাঁর ভারতীয় তালিকায় ক্রমিক নং ৯৮০৫।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডাকে ভারতের প্রশিক্ষণ শেষে মো. ইকবাল হাসান অংশ নেন ৭১’রে মদন মধ্যখালি, ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ির রায়ের বাজার, রয়েলবাড়ি, কেন্দুয়ার ষাটপুর, ঈশ্বরগঞ্জ থানা আক্রমণে সম্মুখযুদ্ধ, মাইজহাটি রেলসেতু ও রামগোপালপুর আর ঈশ্বরগঞ্জ মাঝামাঝি কুটিয়াপুরি সেতু ধ্বংস করার অপারেশনে তিনি অংশ নেন। সেই সময় থাকতেন সহনাটী ইউনিয়নের পাছার ও নেত্রকোণার ভূইয়ার বাজার এলাকায়।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে রওয়ানা দেন। পূর্বধলা পর্যন্ত তিনি একাই ছিলেন। সেখান থেকে গোয়াতলা যাওয়ার পথে কিতাব আলী নামের একজন সঙ্গী পান। তার বাড়ি ফরিদপুর বাবুল অপেরা পার্টিতে কাজ করতেন। দাঁতের ডাক্তার সাথে পরিচয় হয়। রাতে ওই ডাক্তারের আত্মীয় ধর্মবোনের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। ওই বাড়ি থেকে একটি চিঠি লিখে দেন ভুট্টা গ্রামের আজিজ মাস্টারকে দেয়ার জন্য। পরদিন সকালে ভুট্টা গ্রামে যান। তিনি সেই গ্রামের আজিজ মাস্টারের নিকট পত্রটা তুলে দেন। আজিজ মাস্টার পত্রটা পাওয়ার পর খোঁজখবর নিয়ে জানান দেন যে, ওই পাড়ে যেতে এখন কোন সমস্যা নেই। এরপর রওয়ানা হয়ে ঘুষগাঁও যান। ঘুষগাঁও থেকে নদী পার হন। সেই সময়ে দেশের প্রতি দরদ আরো বাড়িয়ে দিলো এক নৌকার মাঝি। ভালো লেগেছিলো মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি পরিচয় দেয়ার পর ওই নৌকার মাঝি টাকা নেয়নি। সেখান থেকে ৭১’র ২৭জুলাই বিকাল ৩টায় শিববাড়ি ক্যাম্পে পৌঁছেন। ওই ক্যাম্পে ছিলেন হাতেম আলী মিয়া, ডা: আব্দুস সোবহান ও গৌরীপুরের পরিচিত আরো অনেকেই। সেখান থেকে ৭১’র ৩১জুলাই আর্মির গাড়ীতে করে তোড়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তিনি যান। সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছিলো ৯৯৬জন গেরিলা। প্যারেড কমা-ার ছিলেন শামছুজ্জোহা নেত্রকোনার। ২১দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ২১আগস্ট কসম প্যারেড গ্রহণ করেন। সেখান থেকে জঙ্গলপ্যারেড করতে আসামে যান।

তিনি বলেন, জঙ্গল প্যারেড শেষে অক্টোবরের ৪ তারিখ মহিষখলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসি। সেখানে অধিনায়ক ছিলেন সেকান্দর নূরী। ওই রাতেই আমরা ৯টা ৫০মিনিটে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। আমাদের সাথে ছিলো ১২টা নৌকা। আমরা ছিলাম ১৮জন। ডিঙ্গাপুতার হাওড় অতিক্রম করে মধ্যখালি আসি। ১১ অক্টোবর প্রথম অপারেশন রায়ের বাজার এক্সচেঞ্জ পুড়িয়ে দেই। আগুন জ্বলছে ঠিক সেই মুর্হূতে পাকবাহিনীও আক্রমণ করে। আমি লাফ দিয়ে পুকুরে পরে যাই। মাথায় কচুরিপনা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি। শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন অনেকটা শীতও ছিলো। তারপর সামনে এগুতেই দেখি চেয়ারম্যান বাড়ি। ওই বাড়িতেই উঠি চেয়ারম্যানের মা (নাম জানা নেই) আমাকে দেখেই খুব আদর-যতœ করেন। হারিকেন জ্বালিয়ে আমাকে উষ্ণতা দেন। একটি শুকনো কাপড়ও এনে দেন।
পাকিস্তানীরা আমাদের সঙ্গে যে বিমাতাসুলভ আচরণ করে তার প্রতিবাদে অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকুরী বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আমাদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই একাএকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিবোই। সেই সিদ্ধান্তেই একাএকাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরি।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করে কী পেলাম; কী পেয়েছি সেটা বড় কথা নয়। আমার জীবনের বড় গর্ব মহান স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি। আমি একজন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক। দু:খ হয় এখনো দুর্নীতির জালে মানুষ জিম্মি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সোনার বাংলা, নবপ্রজন্মের নিকট দাবি জানাবো জাতির জনকের সেই স্বপ্ন, যেন স্বপ্ন থেকে না যায়, তার জন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি ও গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্যে আশানুরুপ উন্নতি এখনো হয় নাই। সুশাসন থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি আবারও ফিরে যান ৭১’র সেই দিনলিপির কথায়, যা মনে হলে রাতের ঘুম ভেঙ্গে যায়, মতি ভাই, মতি ভাই বলে এখনো চিৎকার করেন। গুলিবিদ্ধ সেই যুবকের হাত এখনো ভেসে উঠে। ঘুমের মাঝে এখনও পাকবাহিনীর আক্রমণ নির্যাতনের দৃশ্য দেখতে পান।
তিনি বলেন, সেদিন আমরা ১৮জন গেরিলা। কমান্ডার ছিল হিরু ভাই। ২২ অক্টোবর মাইজহাটি গ্রামে শুক্রবার মাইজহাটির আব্দুর রহিম মাওলানার বাড়িতে সন্ধ্যার দিকে খাওয়া দাওয়া করি। এরপর ওইদিন রাতে মাইজহাটির রেলসেতু ভাঙ্গার জন্য যাই। রাজাকার পাঁচজন ব্রিজে পাহারা দিচ্ছিল। তারা অস্ত্রসহ আমাদের নিকট আত্মসমর্পন করে। রাত প্রায় ১/২ টার দিকে রেলসেতু ধ্বংস করা হয়। সেই সময় রেলসেতুর সঙ্গে টেলিফোন লাইনের বেশ কয়েকটি খুঁটিও ধ্বংস করা হয়। রামগোপালপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ রাস্তার কুটিয়াপুরি সেতু ধ্বংস করি। ২৩অক্টোবর ঈশ্বরগঞ্জ থানা আক্রমণের জন্য দত্তপাড়া যাই। সেখানে থেকে আক্রমণ করি। ফজরের আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। আমরা ক্রোলিং করে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে আসার সময় থানায় থাকা পাকবাহিনী আঁচ করতে পারে। ধানক্ষেতের পাশেই ছিলো ছোট খাল। আমাদের ওপর থানা থেকে ফায়ার শুরু করেছে পাকবাহিনীর সৈনিকরা। থানার পশ্চিমপার্শ্বে জমির বড় আইল ছিলো, আইলেই ছিলো বড় একটি কড়ই গাছ। আইলের এপার থেকে আমরাও ফায়ার করতে থাকি। এভাবেই সারাদিন এভাবেই গুলি বিনিময় চলতে থাকে। এরপর নেমে এলো গোধূলীর অন্ধকার। আমার বাম পাশে ছিল সুলেমান ভাই। নয়জন খাবার খাওয়ার জন্য চলে গেল। ঠিক এই মুর্হূতেই মতি ভাই এলো মুড়ি-মিসরি নিয়ে। আমার আর সুলেমান ভাইকে দিলো। হঠাৎ কিসের শব্দ হইতেছিল মতি ভাই সেই কড়ই গাছের আড়াল থেকে দেখতে চেয়ে ছিলো। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার মাথায় লাগে। মাটিতে লুঠিয়ে পড়ে মতি ভাই। আমি চিৎকার দিয়ে বলি মতি ভাই নাই। সবাই চলে গেল সুলেমান ভাই আর আমি এলএমজি দিয়ে ব্রাস ফায়ার করি। আমরাও উডল করি। মতি ভাইয়ের নিথর দেহটা সেই কড়ই গাছে নিচেই পড়ে রইলো। কড়ই গাছে ঠিক দাঁড়িয়ে রইলো তার অস্ত্র এসএলআর। আমরা মতি ভাইকে আর তার অস্ত্রটা আনতে পারি নাই। মাত্র ৭০/৭৫গজ দূরে আসার পর কান্নার শব্দ পেলাম ‘মা’ মা‘’ বলে চিৎকার। পানি, পানি বলে চিৎকার করছিলো। চেয়ে দেখি আমাদের নিকট থেকে উডল করে যাওয়া হাতেম’ই এভাবে চিৎকার করছে। আমরাও তার কাছে যেতে পারলাম না। পরে তাকে ধরিয়ে দেয় দত্তপাড়া গ্রামের আক্কাস বেপারী। তাকে জবাই করে জমাদার ইদ্রিছ। পরে জানতে পারি। আমাদের কমান্ডার ছিলেন হাসানুজ্জামান হিরু। তার বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের তুলনধর গ্রামে। আর পূর্বপাশে যারা যুদ্ধে অংশ নেয় তারা ছিলেন সালাম গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা।

সেই স্মৃতিময় দিনের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে। যে মতি ভাই শহীদ হলেন তার বাড়ি আমার গৌরীপুরের বীরআহাম্মদপুরে। মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই সময় থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এমন ভুল সংবাদে সেখানে যায় সালাম গ্রুপের তিন জন। ওই রাতে থানায় যাওয়ার পর তারা শহীদ হন। ঈশ্বরগঞ্জ থানা অপারেশনে শহীদ হন গৌরীপুর গিধাউষার আমির হোসেন দুলাল, বীর আহাম্মদপুরের মতিউর রহমান, গৌরীপুরের আব্দুল মান্নান, ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলার শামসুর রহমান, জাটিয়ার তাহের উদ্দিন, আব্দুল খালেক, হরিপুরের হাতেম আলী ও অজ্ঞাতনামা আরেকজন, তার পরিচয় আজও জানা যায়নি।
তিনি নতুন প্রজন্মকে আহবান জানান, তোমরা আদর্শবান সৎচরিত্রের অধিকারী হও। ন্যায়ের পথে চলো। এ দেশকে এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসো। তাহলেই অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম থাকবে না।
তিনি কষ্ট পান, খারাপ লাগে, যখন দেখেন ‘অমুক্তিযোদ্ধারা দেশের মুক্তির সংগ্রামে অংশ না নিয়েই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সুবিধা নেয়.. রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা করেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা একটি সঠিক তালিকা মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ বড় লোক- ছোট লোক ছিল না। মুছি-মাতাব্বর ছিল না। পরিচিত-অপরিচিত সবাই রক্তের বন্ধনে ছিলাম। সবাই ভাই, সহোদর মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়েও আপন ছিলাম। বিপদে একে অপরের সঙ্গে ছিলাম সবাই আমরা বাঙালী। সেই দিনের কথা মনে হলে আর ঠিক থাকতে পারি না। আজ কেন এতো হানাহানি?

টি.কে ওয়েভ-ইন