শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

মুজিবনগর সরকারের ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা সুলতান উদ্দিনের আজও গেজেট হয়নি

প্রকাশিত হয়েছে- সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩
প্রধান প্রতিবেদক || দৈনিক বাহাদুর
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ১৭, ২০২৩, ৫:১৫ অপরাহ্ণ

৭১’র এই দিনে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণের জন্য সুলতান উদ্দিন তালুকদার যান ভারতে। সেখানে যাওয়ার পর এ সরকারের অধিনে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়ী যুব শিবিরে ১৯৭১ সালের মে মাসে যোগ দেন তিনি। ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয়তায় তার নাম ছিলো ‘সুলতান ভাই।’ পারিশ্রমিক হিসাবে প্রতি মাসে ৭৫রুপি হারে ভাতা পেতেন। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের বাড়িওয়ালাপাড়ার আহসান উদ্দিন তালুকদারের পুত্র।

সর্বশেষ ১৯৭১সালের ১৫নভেম্বর তারিখে ৭৫টাকা সর্বশেষ ভাতাও উত্তোলন করেন তিনি। ভাতাভোগীর ১১জনের মধ্যে তাঁর ক্রমিক নং ৯। এ তালিকার ১০জনেই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হয়েছেন। শুধু গেজেটভুক্ত হয়নি সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম! এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আরো একটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা (অর্ন্তভূক্তি) ৪০জনের যে তালিকা প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় সেখানে সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম ১৫নং ক্রমিকে। এ তালিকার অনেকেই গেজেটভুক্ত হয়েছেন। হয়নি সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম। তার বড় ছেলে মহি উদ্দিন তালুকদার লিটন জানান, মুক্তিযুদ্ধ করেছে আমার বাবা বিজয়ের ৫১বছরেও তালিকাভূক্তি না হওয়ায় দুঃখজনক। অপর পুত্র কামরুজ্জামান স্বপন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয়ের জন্য মায়ের পেটে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি দৌড়েছি। আর আজ স্বীকৃতির জন্য এ দফতর থেকে ও দফতরে যাচ্ছি, আসলে যুদ্ধাটা শেষ হলো কোথায়!

১৯৭২সালের ৯ ফেব্রæয়ারিতে ভারতের শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ডা: এম.এ সোবহান প্রত্যয়নে লিখেছেন, মোঃ সুলতান উদ্দিন তালুকদার ১৬ডিসেম্বর বিজয় ঘোষণা পূর্বপর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ক্যাম্পে। শিবিরে দীর্ঘকাল অবস্থানকালীন সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাধিক মূল্যবান ও যুদ্ধাহতদের নিরলসভাবে সেবা দেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এমসিএ হাতেম আলী মিয়া দেয়া প্রত্যয়নপত্রে লিখেন শিবিরে তাঁর দীর্ঘ অবস্থানকালে তিনি সর্বাধিক মুক্তির উদ্দেশ্যে কাজ করেন। তার মনোযোগ ছিলো সবসময় সেবা দেয়া। সুলতান উদ্দিন তালুকদার মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে ৭৫ রুপী সম্মানী ভাতা পেতেন। তিনি এ প্রত্যয়ন প্রদান করেন ১৯৭৭সালের ৭ ফেব্রæয়ারিতে।

দুই সন্তানকে কোলে আর পেটে আরেক সন্তানকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়েছি, কেউ একদিন থাকতে দিলে, পরের দিন না করে দিয়েছে। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে, জানার পর কেউ আশ্রয় দিতে চায়নি। বাড়ি-ঘরে থাকতে পারি নাই, স্বামী ফিরে আসবে কি, না? তাও জানা ছিলো না! এভাবেই যুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনা দেন তার স্ত্রী আছিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, স্বামী দেখে যেতে পারেনি; আমি কী, দেখে যেতে পারবো! স্বামীর নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গেজেটভুক্ত?

তিনি আরো বলেন, স্বামী চলে গেছে; আমিও চলে যাবো। অন্তত স্বামীর প্রাপ্য অধিকারটুকু নিয়ে মরতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হবে স্বামীর নাম, এটা কারো দয়া বা করুণা নয়, এটা হলো আমার স্বামীর কাজের স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি না পেলে আমিও আন্দোলনে নামবো। স্বামী সেবা করতো, আমি আমরণ অনশন করবো। ওকে গিয়ে বলতে পারবো, তোমার স্বীকৃতির জন্য আমিও লড়াই করে এসেছি।

এ কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার আঁচলে মুখ মুছেন আছিয়া সুলতানা। সুলতান উদ্দিন তালুকদার মৃত্যুর সময় তিনি পাননি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও। ২০০৪সালের ৯মে চিরবিদায় নেন। সেদিন ছিলো রোববার। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৮সালের ৩১জানুয়ারি। যুদ্ধের জন্য তিনি নিয়মিত লেখাপড়াও করতে পারেননি। লেখাপড়া ছেড়ে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। পরে ১৯৭২সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্টিক পাস করেন। তার রোল গৌরী নাম্বার পি ৪৭১।
অপরদিকে স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য ২০০৬সালে প্রথম আবেদন করেন আছিয়া সুলতানা। এরপর থেকে বারবার এ দপ্তর, ওই মন্ত্রণালয় ঘুরতে ঘুরতে আজ তিনি ক্লান্ত। সাক্ষাতকার ও যাছাই বাচাইয়ের আসরে যেতে যেতে তিনিও হাঁপিয়ে উঠেছেন। আছিয়া সুলতানের বয়সও ৭০’র কোটা ছাড়িয়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে বার্ধ্যকজনিত নানা রোগ। এই আছেন ভালো, এইতো খারাপ এমন শংকায় কাটছে দিন। তার দু’মেয়ে আম্বিয়া আক্তার জুয়েল ও রোকেয়া আক্তার রুমা জানান, বাবা মুক্তিযোদ্ধা, তা না হলে সরকার বলুক তিনি যুদ্ধ করেননি, ভারতে প্রশিক্ষণ নেননি।

স্বামীর নামটি গেজেটভূক্ত করতে সর্বশেষ ২০১৪সালের ২২ মে অনলাইনে আবেদন করেন আছিয়া সুলতানা। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৭সালের ২৭জুন যাছাই বাচাই হয়। সেই যাছাই-বাচাই কমিটিতে ছিলেন সাত জন সদস্য। তারা হলেন সভাপতি ১৪৮ ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনে এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সদস্য সচিব তৎকালীন ইউএওন মর্জিনা খাতুন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ময়মনসিংহ জেলা কমাÐারের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাÐের কমাÐার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিম, কেন্দ্রীয় কমাÐের কাউন্সিলের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন, জামুকার প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ। এ কমিটির সাক্ষ্য, মুক্তিযোদ্ধার প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে ৬জনকে তালিকাভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন। এ তালিকার ১নং ক্রমিকে ছিলো সুলতান উদ্দিন তালুকাদারের নাম। অথচ অন্যদের হলেও এবারও বাদ পড়েছেন শুধু তিনি। মুক্তিযোদ্ধা নতুন গেজেট সংক্রান্ত ২০২০সালের ১৯জানুয়ারি প্রকাশিত তালিকা নাম দেখে এবার ভেঙ্গে মুচড়ে পড়েন আছিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, এবার শুধু আমি নই; আমার পুরো পরিবার হতাশ। আমার স্বামী যুদ্ধে গিয়েছিলো, তালিকায় নাম তুলতে নয়, যুদ্ধ করতে। আমরা শুধু তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দেখে যেতে চাই।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ বলেন, যে তালিকার ৫জন হলো সেই তালিকার এক নম্বর ক্রমিকের নাম বাদ পড়ে কিভাবে? মুক্তিযুদ্ধ করার পরেও তালিকায় নাম উঠানোর জন্য আরেকটা যুদ্ধ করতে হবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমাÐার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম জানান, যাছাই-বাচাই কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে তার স্বীকৃতির জন্য জোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টি আপিল বিভাগে রয়েছে।