মঙ্গলবার, ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ২৮শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

বইয়ের পৃষ্ঠা আর মায়ের পুঁজি ঈশ্বরগঞ্জের রেজাউলকে এনে দিলো জাতীয় মৎস্য পদক

প্রকাশিত হয়েছে- রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১
মোস্তাফিজুর রহমান বুরহান || স্টাফ রিপোর্টার
  • প্রকাশিত সময় : অক্টোবর, ৩, ২০২১, ৮:০৪ অপরাহ্ণ

৮ম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের এক অধ্যায় তারুণ্যদীপ্ত এক কৈশোরের জীবন বদলে দিলো। বই পড়েই স্বপ্নের বুনন তৈরি করেন তিনি। আর এ স্বপ্নের জগতে প্রবেশের প্রথম টিকেটটিই কেটে দেন তার মা রেখা আক্তার। এটা ১৯৯৯সালের কথা। ২২বছর পর মায়ের টিকেটে এবার রেজাউল ইসলাম রনি পেলেন জাতীয় মৎস্য পদক। তিনি ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের এনায়েতনগর গ্রামের হায়দার আলী ফকিরের পুত্র। এ পদক ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর পক্ষে তুলে দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম এমপি।

রনি ১৪বছর ছুঁইছুঁই করে। অধ্যয়ন করেন ৮ম শ্রেণিতে। পাঠ্য বইয়ের কৃষিশিক্ষা গ্রন্থের ‘ধানক্ষেতে মাছ চাষ’ শিরোনামের অধ্যায়টি বারবার পড়তে থাকেন। নিজের চোখের সামনে ভাসতে থাকে নিজের পরিকল্পনা। তখন সে সোহাগী ইউনিয়ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলো। স্কুলের মাঠটিও মনে হচ্ছিলো এ যেন তার সুনিপুণ পরিচর্যায় রূপায়িত স্বপ্নের বীজতলা। শ্রেণিকক্ষে বসে জানালার ফাঁকে বারবার তাকায় আর ভাবে এমন স্বপ্নের বাস্তবায়ন কবে হবে।

স্বপ্নটি পূরণের জন্য ছুটে যান মায়ের কাছে। ছেলের আবদার কোনভাবেই ফিরিয়ে দিতে পারেননি মা রেখা আক্তার। ধানবিক্রি করে ছেলের হাতে তুলে দেন ৫হাজার টাকা। এ যেন স্বপ্নের টিকেট হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই টাকা নিয়ে ছুটলো রনি। রনি যখন টাকা নিয়ে ছুটাছুটি করর্ছিল তখন তার বাবা ডেকে বলল, বাবা তোমার কি হয়েছে ? রনি খুবই খুশি মনে বাবাকে বলল, মা আমাকে মাছ চাষের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তখন তার বাবা অনুপ্রানিত হয়ে বলল, বাবা তুমি বাড়ির সামনের ঐ পরিত্যক্ত ৩০ শতাংশ পুকুরে মাছ চাষ শুরু কর। বাবা তোমার মা দিল টাকা আর আমি দিলাম পুকুর। রনি স্বপ্নযাত্রা শুরু করে ১৯৯৯সালে। প্রথম বছর মাছচাষে মায়ের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে বিক্রি করেন আট হাজার টাকার মাছ। তিন হাজার টাকা লাভ হওয়ায় রনির মা বাবা খুবই খুশি হন। রনির স্বপ্নের যাত্রা আরও বেগবান করে তুলে। পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিল রনি। পড়াশোনার জন্য মাছচাষ একটু থমকে গেলেও পিছপা হয়নি রনি। ২০০৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রনি। উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে খালোর ফিশারিতে মাছচাষ ও হ্যাচারিতে হাতে কলমে কাজশিখে ২০১২ সাল পর্যন্ত। ২০১৩ সালে আবার সেই ৩০ শতক পুকুরে থাই কৈ চাষ করে ছয় মাসে লাভ হয় দুইলক্ষ টাকা। সেই লাভের টাকা দিয়ে চারটি হাউজ তৈরি করে হ্যাচরি ব্যবসা শুরু করে রনি।
মায়ের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা আর বাবার একটি পুকুর থেকে রনি আজ কোটিপতি ও ৬৫টি পুকুরের মালিক। কোনরকম ব্যাংক লোন আর দেনা ছাড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তার ব্যবসা। রেজাউল ইসলাম রনির প্রতিষ্টানের নাম হচ্ছে ফ্রেশ ওয়াটার ফিশ হ্যাসারি। এলাকার মাছচাষীরা গুনগত পোনা উৎপাদনের রনির হ্যাচারিকেই চিনেন। রনি হ্যাচরিতে রুই , ক্যাটফিশ, দেশি পুটি, মলা, খৈইলশা , ফলঈ, টেংরা, পারদা সহ ১৮ প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন করছে।
গত বছর থেকে বাংলাদেশ মৎস গবেষনায় উদ্ভাবিত সূবর্ন রুইয়ের ব্রোড সংগ্রহ করে এবছর প্রায় দশলক্ষ পোনা উৎপাদন করেছে। প্রতিটি সূর্বন রুইয়ে পোনা গড়ে দশ টাকা করে বিক্রি করছে সে। রনির ৬৫টি পুকুরের মাঝে ৩০টিতে বিভিন্ন প্রজাতি মাছ নিভির চাষ ও ১৫টি পুকুরে ব্রোড মাছ এবং ২০টি পুকুরে নার্সারি চাষ করছে। ২০২০ সালে করোনা কালীন সময়ে মাছের দাম কিছুটা কম থাকায় সে অর্ধকোটি লাভ পেয়ে ছিল। তবে এবছর মাছের দাম ভাল থাকায় কয়েক কোটি টাকা লাভের সপ্ন দেখছে সে। রেজাউল শুধু নিজেরই স¦াবলম্বি হয়নি ২৫ জন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে সে। রেজাউল ইসলাম রনি বাংলাদেশের অন্যন্য দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরনা।

ঈশ্বরগঞ্জের উপজেলার সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা এ এস এম সানোয়ার রাসেল  জানান রেজাউল ইসলাম রনি ছোট বেলা থেকেই মাছচাষে আগ্রহী। সে প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির দেশিয় মাছ নিয়ে কাজ করছে সে। গতকাল আমি তার ফার্ম বিজিট করতে গিয়েছিলাম, সে দেশিয় প্রজাতির মাছনিয়ে কাজ করছে। যেমন দেশি কৈ, তারাবাইম, মলা মাছের পোনা উৎপাদর ও চাষ করছে সে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে রনি বাংলাদেশের জন্য অনন্য অবদান রাখবে।