রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১৯শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

পরিবর্তনের রূপকার

প্রকাশিত হয়েছে- রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : ডিসেম্বর, ২০, ২০২০, ৫:৪০ অপরাহ্ণ

বাহাদুর ডেস্ক :

স্যার ফজলে হাসান আবেদ, বিশ্বজুড়ে যিনি স্যার হিসেবে পরিচিত, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় আবেদ ভাই ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে (বানিয়াচঙ্গ, হবিগঞ্জ) জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। হবিগঞ্জ জেলা সদরে তার ছাত্রজীবন শুরু। তারপর খুলনা থেকে মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর লন্ডনে চলে যান এবং উচ্চশিক্ষা লাভ করেন সেখান থেকেই। তিনি কাজের চাপে আমাদের পরিবারের সদস্যদের খুব একটা সময় দিতে পারতেন না বটে; কিন্তু তার ধীশক্তি এত প্রখর ছিল, যা তুলনারহিত। পরিবারের সদস্যদের জন্মতারিখ, বিয়েবার্ষিকীর তারিখ ইত্যাদি তার মনে থাকত। ১৯৮৭ সালের পর তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন।

আমাদের বাড়িটা এখনও ভাগবাটোয়ারা হয়নি। আমরা যখন যারা বাড়িতে থাকি তারাই দেখাশোনা করি। এ আমাদের এক পারিবারিক ঐতিহ্য। তার উদ্যোগে ২০১৮ সালে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ‘হাসান মঞ্জিল ফ্যামিলি ট্রাস্ট’ গঠন করা হয়। তিনি এই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন এবং আমি সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এখনও এ ট্রাস্ট তার অনুসৃত নীতি-আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। তারই উদ্যোগে বাড়ির কাছে নজমুল হাসান জাহেদের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি শিক্ষা একাডেমি। আমাদের পরিবারের আরেক অগ্রজ শহীদ সায়ঈদুল হাসানের নামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গণপাঠাগার কেন্দ্র। তার আরও অনেক পরিকল্পনা ছিল বানিয়াচঙ্গ ঘিরে। বিশেষ করে শিক্ষার প্রসারে এলাকায় আরও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ার পরিকল্পনা তার ছিল। আমার সৌভাগ্য, তার মতো এমন একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের কাছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আমি বেশি প্রাধান্য পেতাম এসব কাজে।

১৯৭০ সালে ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বখ্যাত শেল অয়েল কোম্পানির চট্টগ্রাম অফিসে উচ্চ পদে যোগ দেন। ওই বছরের ১২ নভেম্বর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চল। সে সময় তিনি বন্ধুদের নিয়ে ‘হেলপ’ নামে একটি সংগঠন গড়েন এবং ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শেল অয়েল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে ইসলামাবাদ ও কাবুল হয়ে লন্ডন চলে যান। লন্ডনে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন। লন্ডনে ফজলে হাসান আবেদের একটি ফ্ল্যাট ও গাড়ি ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং ফ্ল্যাট ও গাড়িটি বিক্রি করে দেন। এই অর্থ দিয়েই শুরু হয় তার জীবনের আরেক অধ্যায়। যেসব শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসতে শুরু করলে তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন মগবাজারে ছোট একটি অফিস নিয়ে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়েন। পরে এ সংগঠনটি ‘ব্র্যাক’ নামে পরিচিতি পায়। এ সংগঠনের মাঠ পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্র হিসেবে তিনি প্রথমেই বেছে নেন সুনামগঞ্জের শাল্লা ও বানিয়াচঙ্গের মার্কুলী নামক দুটি জনপদ। তার স্বপ্নে গড়া ব্র্যাক প্রতিষ্ঠানটি আজ একটি বহুমুখী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যার অস্তিত্ব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও বিস্তৃত। ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও তার স্বপ্নের ফসল।

আমার কৃতী ভাইয়ের অর্জনের খতিয়ান দীর্ঘ। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাকে নিয়ে কিছু লেখা দুরূহ। তিনি অনেক সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের সম্মাননা পুরস্কারও পেয়েছেন অনেক। এসবের তালিকাও খুব দীর্ঘ। আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিবেদিত স্যার ফজলে হাসান আবেদ শারীরিকভাবে প্রস্থান করলেও তার দীর্ঘ কর্মময় জীবন যুগ যুগ ধরে মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হয়ে থাকবে। তাকে পরিবর্তনের রূপকারও বলা যায়। সহমর্মিতার গভীর জীবন দর্শন, অসাধারণ সাংগঠনিক ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন তার পরিচয় জীবনব্যাপী ব্যাপৃত। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসারসহ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় তার দূরদর্শী চিন্তার সুফলভোগী আজ অসংখ্যজন। তিনি বলতেন, সমস্যাকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে হবে।

বিনয়ী, কর্মনিষ্ঠ স্যার ফজলে হাসান আবেদের দ্যুতিময় জীবন-অধ্যায়ের জন্য আমরা গর্বিত। আজ সমাজ ও দেশে যখন দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষীদের দাপট, তখন তার স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। জ্ঞান, সাহস, মানবতা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, যোগ্যতা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি ব্যক্তি থেকে যেন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি যেভাবে তার অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটিয়ে গেছেন তা অনুসরণযোগ্য। স্বাপ্নিক স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেখিয়ে গেছেন, চিন্তা-পরিকল্পনা-দক্ষতা-যোগ্যতার যথাযথ প্রতিফলন ঘটিয়ে কীভাবে দৃষ্টান্তযোগ্য কিছু করা যায়। নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষকে ছায়া দেওয়ার জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহিরুহ। বিনম্র হৃদয়ধারী স্যার ফজলে হাসান আবেদকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

টি.কে ওয়েভ-ইন