রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১৯শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

দিল্লির মসনদে করোনার ভয়াল থাবা ও স্বজন হারানোর আর্তনাদ || মোঃ আল ইমরান মুক্তা

প্রকাশিত হয়েছে- শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১
||
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ৩০, ২০২১, ৮:২৮ অপরাহ্ণ

ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দেশটির  রাজধানী নয়া দিল্লির। দিল্লির অলিতে-গলিতে মৃত লাশের গন্ধ। স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। শ্মশান ও গোরস্তানে লাশের দীর্ঘ মিছিল। চারদিকে পঁচা লাশের দুর্গন্ধ। চিতার দাহে আকাশ কলো বর্ণ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের ভাষ্যমতে, এটি করোনার তৃতীয় ধাপ চলছে। অথচ এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাদের প্রস্তুতি অপ্রতুল বলে মনে হচ্ছে। ঐ দেশের সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে প্রতীয়মান হয় যে, তারা অপ্রস্তুত। গবেষকগণ ইতোপূর্বে বলেছেন, করোনা একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। এর প্রকোপ দীর্ঘদিন থাকবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কার্যকরী ভূমিকা চোখে পরেনি। ঠিক যেন পরার্থ দায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত অক্সিজেন। এমনকি চিকিৎসক ও নার্স প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এক কথায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুখথুবড়ে পড়েছে। বলুন, এই দায় কার উপর বর্তায়?

ভারত সরকারের নির্বাচনী প্রচারণার মহোৎসব চলছে। সভা সমাবেশে লক্ষ জনতার ভীর। একই সাথে আইপিল খেলাও চলছে। অপ্রিয় হলেও বলতে দ্বিধা নেই, এই খেলাকে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশে জুয়ারিদের আসর বসে। থাক সেসব কথা। এদিকে অসচেতন লক্ষাধিক  অন্ধত্ববাদী গঙ্গাস্নান ও কম্বো মেলায় মেতেছে। এই ভয়াবহতার মধ্যেও হাসপাতালে ব্যতিক্রম ভাবে সম্পন্ন হয়েছে বিয়ের আয়োজন। এত অবিবেচক  কার্যক্রম! ভরতে গত বছর কিছু জ্ঞান পাপীর প্ররোচনায় করোনার প্রতিষেধক হিসাবে গো মুত্রের প্রচলন হয়েছিল। এসব ব্যর্থ প্রচেষ্টা! চিকিৎসা সেবায় ভারতের অনেক সু-খ্যাতি শোনেছি। প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে ভারতের তামিলনাড়ু ও বেঙ্গালুরুতে অনেক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে যায়। এখন দেখছি, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি এর চিকিৎসা ব্যবস্থা ততটা মানসম্মত সীমায় উন্নীত হয়নি। যে কারণে করোনা মোকাবেলায় তারা হিমসিম খাচ্ছে। টিকা উৎপাদনে যে দেশটি পৃথিবীতে শীর্ষে রয়েছে, তাদের অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে বাংলাদেশ প্রস্তুত তো?

ভারতে কাকতালীয় ভাবে করোনার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়নি। নিশ্চয়ই এর পিছনে যৌক্তিক কিছু কারণ রয়েছে। বর্তমানে ভারত সরকারের স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, অসচেতনতা ও অসাবধানতার বহিঃপ্রকাশ এই মহামারি কে আলিঙ্গন করেছে। এদিকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতি যে খুব ভালো তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। ভারতের অনুরূপ পরিস্থিতি হলে, এদেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাড়াবে? ভাবতেই গা-শিউরে ওঠে।

গতবছর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং এ বলা হয়েছিল,  শীগ্রই দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসিউ চালু করা হবে। এভাবে একটি বছর চলে গেলো। কোথায় সেই আইসিউ? আজও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। কী উত্তর দিবেন সরকার বাহাদুর? গত পঞ্চাশ বছরে স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমান বাজেট বরাদ্দ হয়েছে, তাতে অনেক পূর্বেই আইসিউ থাকা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু নিরাশার কথা হলো, গত বছর নির্মিত কোটি টাকার হাসপাতাল এ বছর উধাও হয়েগেছে। অস্বাভাবিক সব কর্মকাণ্ড। আরো দুঃখজনক হলো, দায়িত্বশীল অনেকেই এসব প্রসঙ্গ আসলে পাশকাটিয়ে যায়। ঠিক ভিনদেশি অতিথির মতন!

জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় গুটিকয়েক ধনকুবের বিদেশ চলে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ব্যাপক ভাবে প্রচার হয়েছে। কী অবিবেচক! এসব স্বার্থপরের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি। রাষ্ট্রীয় ভাবে তাদের সকল সম্পদ ক্রোক করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে নাগরিকত্ব বাতিল করার জন্য বলবো। স্বদেশের আলো, ছায়া তাদের কে সজিবতা দিয়েছে। তারা স্বদেশ থেকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এই বিপদের সময়ে তাদের পরবাসী হবার উদ্ধত আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। তারা চিরন্তন  সত্যকে ভুলে গেছে। তাই এই ছলচাতুরী ও লুকোচুরি করছে । কিন্তু তারা মৃত্যু ভয়ে যেখানেই পলায়ন করুক না কেন, মৃত্যু যখন আসবে, তখন সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

তবে আশার কথা হলো, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক থাকার পরও পাকিস্তানে জনগণের চাপে পাকিস্তান সরকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত হবে অনতিবিলম্ব না করে, সাধ্যমত সহযোগিতার হাত প্রসস্থ করা। মানুষ মানুষের জন্য। জীবন জীবনের জন্য। দেশে-দেশে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হোক। এটাই কামনা করি। দিল্লির বিভিন্ন  মসজিদ,মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে চলছে করোনা রোগীর চিকিৎসা। স্বেচ্ছাসেবীগণ জীবনের ঝুঁকি জেনেও মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে। এখানে ধর্মীয় ভেদাভেদ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই তো মানবতা। মানবতার জয় হোক।

গত বছর শুরু’র দিকে বিমান বন্দর থেকে বেশ কয়েকজন  করোনা পজিটিভ প্রবাসী নিয়মবহির্ভূত ভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। এজন্য কতিপয় বিমান বন্দর কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছিল। অতি সাম্প্রতিক সময়ে যশোর হাসপাতাল থেকে ভারত ফেরত ১২ জন করোনা রোগী পালিয়েছে। মানুষ এত অসভ্য হতে পারে।    যারা দায়িত্বে ছিল তারা কোন বনে বিচরণ করছিল কে জানে? এসব ফাঁকিবাজের দল। এই হলো দায়িত্বশীল আচরণের নমুনা। এই হলো দেশপ্রেমের উচ্ছ্বসিত বচনের ফুলঝুরি । এদের কাছে জাতি কী আশা করতে পারে? হতাশা নিয়েই বলতে হচ্ছে, এমন অকর্মণ্যদের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করা নিছক অনুমান মাত্র।

সরকার ১৪ দিনের জন্য ভারতের সাথে বিমান ও পরিবহন যোগাযোগ এর উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বটে। তবে বিধিনিষেধ অন্তত ৩ মাস দীর্ঘ করার জন্য অনুরোধ করছি। পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। সীমান্ত অঞ্চলে বিশেষ দৃষ্টি রাখা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সীমান্ত প্রহরীর কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিতে সাহায্য করে। বহিরাগতরা সঙ্গে করে মাদক বা অগ্নেয়অস্ত্র কী নিয়ে প্রবেশ করলো এই  বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই। বরং অনৈতিক প্রবেশ অনুমতির নজির রয়েছে। করোনা পজিটিভ কোন ব্যক্তি যদি প্রবেশ করে, তাহলে আমাদের দুর্দশার অন্তত থাকবে না। তাই এক্ষেত্রে সিমান্ত রক্ষা বাহিনীর কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অস্থায়ীভাগে সীমান্তে নিয়োজিত করা কাম্য।

করোনা মোকাবেলায় সিদ্ধান্তহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনুগ্রহ করে তামাশা ডাউন বন্ধ করুন। অবশ্যই  পরিকল্পিত লকডাউন এর বিকল্প নেই। এজন্য সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি। রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু ব্যাংক পাঁচদিনের পরিবর্তে তিনদিন খোলা রাখা হয়েছে। এতে করে সমস্যার তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যা দৃশ্যমান হচ্ছে। এতে করে কাজের চাপ অনেক বেড়ে গিয়েছে। পাঁচ দিনের কাজ তিনদিনে সম্পাদন করতে হচ্ছে। ব্যাংকিং সেবা প্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন স্বাস্থ্যবিধি কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।

সাম্প্রতিক একটি অভিযোগ উঠেছে যে, প্রবাসীরা এদেশে এলে, তাদের কে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন এ রাখার জন্য হোটেল ভাড়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই করুন পরিস্থিতিতেও তছরুপ বন্ধ হচ্ছে না। অথচ এই দুর্যোগকালীন সময়েও প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে।  কর্তৃপক্ষ একটু সদয় হলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব বলে মনে করি। গত বছর করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে, বাংলাদেশ সরকার সময়মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিলম্ব করেছিল। এ বিষয়টি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। অতএব, এই ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, এজন্য কর্তৃপক্ষ কে সবিনয় অনুরোধ করছি।

লেখক : মোঃ আল ইমরান মুক্তা, শিক্ষানবিশ আইনজীবী

জজ কোর্ট, ময়মনসিংহ।