শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্ভিদ ও রোগত্ত্ববিদের দেখুন বিশ্লেষণ

প্রকাশিত হয়েছে- বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ১৬, ২০২০, ৪:০৫ পূর্বাহ্ণ
হুমায়ুন কবির :
Bangladesh Agricultural University at PhD Fellow
করোনা ভাইরাস ও উদ্ভিদ রোগত্ত্ববিদ হিসাবে আমার
কিছু উপস্থাপনা:
উদ্ভিদ বা প্রাণীর যে কোন রােগ বিস্তারের জন্য তিনটি বিষয়ের প্রয়োজন হয়:
১।Host ২। Pathogen ৩। Environment
করোনা ভাইরাস এর ক্ষেত্রে Host হচ্ছে মানুষ অার Pathogen হচ্ছে Virus- SARS- CoV-2.
গাছের ভাইরাস রোগের ক্ষেত্রে রোগটি ছড়ায় বিভিন্ন Vector অর্থাৎ পোকামাকড় দ্বারা। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে মানুষের হাচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। গাছের ক্ষেত্রে অামরা কীটনাশকের মাধ্যমে Vector মেরে ফেলি এবং অাক্রান্ত গাছটি ক্ষেত থেকে সরিয়ে ফেলি।
যা মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব না। পরিবেশের উপর অামাদের হাত নেই। তবে ভাইরাসটিকে দূর্বল বা মারতে পারলে বা প্রতিষেধক তৈরী করতে পারলে রেহাই পাওয়া যাবে।
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে একটু ধারনা:
করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ “মুকুট”। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায়। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রূপ প্রকাশ করে। ধারনা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে।
ভাইরাসটি কোন একটা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়াতে ছড়াতে আবার নিজের জিনগত গঠনে সবসময় পরিবর্তন আনছে – যাকে বলে মিউটেশন।
কিন্তু এ ভাইরাসটির প্রকৃতি এবং কিভাবেই বা তা রোধ করা যেতে পারে – এ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন।
সার্স বা ইবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এই করোনাভাইরাস তার মধ্যে সর্বশেষ।
ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরণের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই ‘মিউটেট করছে’ অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে – যার ফলে এটি আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১শে ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এর পর ১১ই জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেন নি বিশেষজ্ঞরা।
তবে তারা বলছেন, সম্ভবত কোন প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোন মানুষের দেহে ঢুকেছে, এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে।
সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকে। মার্স ভাইরাস ছড়ায় উট থেকে।
এর সাথে উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজারে গিয়েছিল এমন লোকদের সম্পর্ক আছে বলে বলা হচ্ছে।
ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো
কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলুগা জাতীয় তিমি করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। তবে উহানের ওই বাজারে জ্যান্ত মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, এবং সাপ বিক্রি হতো।
হয়তো এগুলোর কোন একটি থেকে এই নতুন ভাইরাস এসে থাকতে পারে।
আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে কী লক্ষণ দেখা যায় ?
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি।
কিন্তু এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তার পর দেখা দেয় শুকনো কাশি।
এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন কোন কোন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
মানুষের মধ্যে যখন ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেবে তখন বেশি মানুষকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে তাদের। তবে এমন ধারণাও করা হচ্ছে যে নিজেরা অসুস্থ না থাকার সময়ও সুস্থ মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে মানুষ।
এই ভাইরাস কত বিপজ্জনক সেটা একটা প্রশ্ন। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের ৮০% স্বাভাবিক সুস্থতা,১৪% কিছু জঠিলতা এবং ৬% মানুষ বেশী খারাপ হয়ে যায়। তা ছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে যা চিহ্নিত হয় নি।
নিম্নবর্ণিত সতর্কতা অবলম্বন করলে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ সতর্কতাগুলো কী? সেগুলো তুলে ধরা হলো।
১. গণপরিবহন
গণপরিবহন এড়িয়ে চলা কিংবা সতর্কতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বাস, ট্রেন কিংবা অন্য যে কোন ধরণের পরিবহনের হাতল কিংবা আসনে করোনাভাইরাস থাকতে পারে।
সেজন্য যে কোন পরিবহনে চলাফেরার ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা এবং সেখান থেকে নেমে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
২. কর্মক্ষেত্র
অফিসে একই ডেস্ক এবং কম্পিউটার ব্যবহার করলেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁচি-কাশি থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়। যে কোন জায়গায় করোনাভাইরাস কয়েক ঘন্টা
এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। অফিসের ডেস্কে বসার আগে কম্পিউটার, কিবোর্ড এবং মাউস পরিষ্কার করে নিন।
৩. জনসমাগমস্থল
যেসব জায়গায় মানুষ বেশি জড়ো হয় সেসব স্থান এড়িয়ে চলা কিংবা বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর মধ্যে খেলাধুলার স্থান, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় স্থানও রয়েছে।
বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে জুমার নামাজের সময় বাড়ি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ওমরাহ বন্ধ করেছে।
৪. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যখন গ্রাহকরা যায় তখন অনেকেই একটি কলম ব্যবহার করেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি যদি সে কলম ব্যবহার করে তাহলে পরবর্তী ব্যবহারকারীদেরও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
সেজন্য নিজের কলম আলাদা করে রাখতে পারেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে।
এছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য যে এটিএম বুথ ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। কারণ এটিএম বুথের বাটন অনেকে ব্যবহার করে।
৫. লিফট
ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আরেকটি জায়গা হতে পারে বাড়ি কিংবা অফিসের লিফট।
লিফট ব্যবহারের সময় নির্ধারিত ফ্লোরে যাবার জন্য লিফটের বাটন অনেকে ব্যবহার করছেন।
বিভিন্ন অফিস ভবনে প্রতিদিন শত-শত মানুষ লিফট ব্যবহার করছেন।
এদের মধ্যে কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থাকেন এবং সে লিফটের বাটনে অন্যদের আঙ্গুল গেলেও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
৬.টাকা-পয়সা
ব্যাংক নোট বা টাকায় নানা ধরণের জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্ত করার ঘটনা নতুন নয়।
এমনকি ব্যাংক নোটের মাধ্যমে সংক্রামক নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথাও বলেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের একদল গবেষক গত বছরের অগাস্ট মাসে বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশি কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রায় এমন ধরণের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন, যা সাধারণত মল-মূত্রের মধ্যে থাকে।
গতমাসে ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে টাকা বা ব্যাংক নোট জীবাণুমুক্ত করার একটি উদ্যোগ দেখা যায় চীনে।
দেশটিতে সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সেখানে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে বাজার থেকে ব্যাংক নোট সরিয়ে নিয়ে তা আবার জীবাণুমুক্ত করে বাজারে ছাড়ে দেশটি।
৭. শুভেচ্ছা বিনিময়
করমর্দন এবং কোলাকুলির মাধ্যমেও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে।
আপনি যে ব্যক্তির সাথে কোলাকুলি এবং করমর্দন করছেন, তিনি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে সেটি অন্যের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
এজন্য করমর্দন এবং কোলাকুলির না করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সবকিছুর মূল কথা হচ্ছে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা।
তাছাড়া অারও নজর দিতে হবে:
১।অাক্রান্ত ব্যাক্তির কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে
২।সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে
৩।হাতে মাস্ক এবং গ্লোবস পরে বের হতে হবে
৪।সাবান পানি দিয়ে বার বার হাত ধৌত করতে হবে।হাত না ধুয়ে নিজের মুখমণ্ডল স্পর্শ করবেন না। এটি হলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য নিয়মিত ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
৫।রোগ প্রতিরোধী খাবার যেমন টাটকা শাক সবজি ফলমূল ও মসল্লা জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে
৬।ঘরে থাকার চেষ্টা করতে হবে
৭।লেবুর রস দিয়ে কসুম গরম পানি খেতে হবে
৮।দ্রুত বেশী সংখ্যক পরীক্ষা করে অাক্রান্ত রোগী অাইসোলেশনে নেওয়া
৯।ব্যায়াম করা।
সহযোগীতায়:বিবিসি,উইকপিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া।
ধন্যবাদ।
ফেসবুক : https://www.facebook.com/humayun.dae