রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ২৬শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

একজন আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও আজকের বাংলা সাহিত্য

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : সেপ্টেম্বর, ৩০, ২০২০, ১:১২ অপরাহ্ণ

মোখলেছুর রহমান,স্টাফ রিপোর্টারঃ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাংলা জাগরণের কালজয়ী সাহিত্যিক। চট্টগ্রামের ক্ষণজন্মা কৃতিপুরুষদের মধ্যে এই মহান ব্যক্তি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মনীষী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া এই কালজয়ী মহাপুরুষের জন্মস্থান তাঁকে নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ গর্ব করে। চট্টগ্রামের অনেক গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নাম সবার আগে চলে আসে। প্রাচীন পুথিপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান জাতিকে তাদের আত্মপরিচয়ের বিশাল সন্ধান তিনি দিয়ে গেছেন।

বাংলার শক্তিমান মুসলমান জাতির ইতিহাসকে যিনি বাঙালীর মনের ও মননের ইতিহাসে- স্বগৌরবে এনে আমাদের সমাজ, জাতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি আবদুল করিম। যিনি কেরানী থেকে উঠে এসে হয়েছেন সমাজ-সাহিত্যের কিংবদন্তি। সর্বশ্রেণির মানুষের ভালবাসা আর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সাহিত্য বিশারদ ও সাহিত্য সাগর উপাধি পেয়ে ধন্য হয়েছেন। বাঙালী মুসলমানদের সাহিত্য জ্ঞানের পরিচয় দেয়ার ঐতিহ্য উদ্ধারকারী মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামের ইতিহাসের প্রাচীন জনপথ- পটিয়া সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা আর বাঙালীর ইতিহাসের শক্তিমান গবেষক হিসেবে তিনি নিজেকে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হন। গবেষক, সংগ্রাহক ও পুঁথি সংরক্ষনকারী হিসেবে দুই বাংলাতে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। অর্জন করেছেন অনেক নামী দামী পুরস্কার। যদিও তিনি কিছু পাওয়ার আশায় করেননি। জাতির ছেড়া তলেতে ভরপুরের আশায় সারা জীবন যে লুপ্ত ইতিহাস খুঁজতে ঘর থেকে ঘরে, পথ থেকে পথে পথে ঘুরেছেন। উদ্ধার করেছেন অনেক দুর্লভ ঐতিহাসিক সম্পদ। তাঁর দেয়া সম্পদের কারণে আজ আমরা জাতিগত অর্থে নিজেদের নামী দামী মানুষ মনে করি। অথচ আমরা যার কারণে এত উন্নত জাতি হয়েছি- তাঁকে অতি সহজে আমরা ভুলতে বসেছি। ইতিহাস আবিষ্কার করার মতো আমাদের অবস্থা হয়েছে। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্র কিংবা চট্টগ্রামের প্রশাসনিকভাবে পালিত হয় না। মৃত্যুর পর তাঁর সাথে আমরা বিমাতাসুলভ আচরণ করছি। তাঁরই নামে নামকরণকৃত সড়ক আজ অন্য নামে লিখা হয়। বাংলা সাহিত্যের অমর দিকপাল মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়া মহকুমায় ইন্তেকাল করেন। সাহিত্য বিশারদ সারা জীবন পুঁথি সাহিত্যের উপকরণ সংগ্রহে কাটিয়েছেন এবং সেই বিপুল উপকরণকে দেশ ও জাতির সামনে রেখে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হিসেবে প্রদান করেছেন। জীবনের শেষ বয়সে তিনি পটিয়ার নিজ গ্রামে বসবাস করতেন। সাহিত্যপ্রেমিক এই মানুষের উদাহরণ আজ অবধি অন্যকোন কেউ সেই ইতিহাস ভঙ্গ করতে পারে নি। মৃত্যুর বিছানায়ও সাহিত্য বিশারদ সাহিত্যের অমর উদাহরণ দিয়ে গেছেন। মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ যখন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েন তখনও তাঁর হাতে ছিল লেখনী। এফ-এ পরীক্ষার গণ্ডি অতিক্রমের পর তাঁকে জীবনের তাগিদে প্রথমে কেরানী জীবনে প্রবেশ করতে হয়। চট্টল বিখ্যাত কবি নবীন চন্দ্র সেনের অধীনে তিনি কিছুদিন কাজ করেন। পরে চট্টগ্রামে ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর অফিসে কেরানীর চাকুরিতে নিযুক্ত হন। কিন্তু তাঁর পরিচয় কেরানী নয়, বরং তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যসেবী। তাঁর অবদানে বাংলা সাহিত্য চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে। জন্মের পূর্বেই তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রথম এন্ট্রাস পাস করা লোক। সম্ভবত বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তিনিই প্রথম দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সংস্কৃত নিয়ে এন্ট্রাস পাস করেছিলেন। এফ.এ. পর্যন্ত পড়েছেন। আর্থিক অসচ্ছলতা তাঁকে কলেজ ছাড়তে বাধ্য করে। নবীন চন্দ্র সেন ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারী। তিনি আবদুল করিম সাহেবকে কমিশনার অফিসে চাকুরির ব্যাপারে সাহায্য করেন এবং সাহিত্য চর্চার জন্য তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তার স্বগ্রাম থেকে কালিশঙ্কর চক্রবর্তী প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জ্যোতি’ পত্রিকায় আবদুল করিম পুঁথি সংগ্রহের জন্য একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। যার ফলে তাঁর ও নবীন চন্দ্র সেনের চাকুরি হারানোর উপক্রম হয়। আশ্চর্যজনক বিষয় নবীন বাবু বেঁচে গেলেন! কিন্তু আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। অতঃপর তিনি আনোয়ারা মিডল হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের চাকরি পান। হাই স্কুলের চাকুরিতে থাকাকালে তিনি অধিকাংশ পুঁথি সংগ্রহ করে বাংলা ভাষার ভাণ্ডারকে ঐশ্বর্যময় করেছেন। এরপর তিনি বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর অফিসে কেরানীর চাকুরি নেন। এতে তাঁর কিঞ্চিৎ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বিধান হয় এবং তিনি সাহিত্য চর্চার সুযোগ পান। ১৯৩৩ সালে সরকারী চাকুরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে যাঁরা সাহিত্য সাধনায় উৎসাহ দিয়েছেন, কবি নবীনচন্দ্র সেন, বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর জনাব আবদুল করিম বি.এ, শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বি.এ. এঁদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আশ্চর্য! কেরানীগিরি করেও তিনি নিরলস সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। হর প্রসাদ শাস্ত্রীই প্রথম ব্যক্তি যিনি সরকারী অর্থে বাংলা পুঁথির সন্ধান ও সংগ্রহ করেন। কিন্তু একই সময়ে কোন সহায় সম্বল ছাড়াই আবদুল করিম সাহেব পুঁথি সংগ্রহে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। একমাত্র হৃদয়ের টানে কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয়ে ও শারীরিক শ্রমে এসব অমূল্য রত্নের ভাণ্ডার উদ্ধার করেছেন। তিনি এমন সব কাব্য উদ্ধার করেছেন যার দ্বিতীয় কপি অন্য কোথাও নেই। হর প্রসাদ শাস্ত্রীর সংগৃহীত পুঁথি-পত্র থেকে সাহিত্যের বিরাট ইতিহাস রচিত হয়। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে হিন্দুদের অবদান স্বীকৃত হয়। হিন্দুরা মুসলমান রচিত কোন পুঁথি সংগ্রহ করেননি। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদই প্রথম ব্যক্তি যিনি একনিষ্ঠভাবে মুসলমানদের রচিত পুঁথি-পুস্তক সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সাধনা ও গবেষণার ফলে বাঙালি জনসাধারণ জানলো যে, বাংলা সাহিত্যের আদি কবি মুসলমান, বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য প্রদান করে প্রথম মুসলমান কবিগণ প্রথম মৌলিক কাব্য রচনা করেন। মুসলমান কবি মরদন ও মাগন ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের ভাষাকে প্রথম শালীনতা দান করেন মুসলমান কবি আলাওল। এক কথায় তিনিই জানিয়ে দিলেন যে, বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি, পুষ্টি ও বৈচিত্র্য সাধনের মূলে রয়েছে প্রথমত ও প্রধানত মুসলমানদের সাধনা। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যযুগীয় গৌরবময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে সচেতন ও উৎসুক করে তোলেন। তিনি বলেছেন, “ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগই সংস্কৃতি সাধনার আসল সোপান।” দীর্ঘ ৬৫ বছর যাবত তিনি নিরলসভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বহু পুঁথি সংগ্রহ করে গেছেন। মুসলমান রচিত পুঁথিগুলি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহায্যে তিনি ‘গোরক বিজয়’, ‘জ্ঞান সাগর’, ‘সারদা মঙ্গলমৃগবলুব্ধ’, ‘গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’ প্রভৃতি কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। সাহিত্য পরিষদ তাঁর পুঁথির বিবরণীর কতকাংশ ছেপেছিল। তাঁর সম্পাদিত পদ্মাবতী অর্থাভাবে প্রকাশিত হয়নি। ‘পদ্মাবতী সংকলন’, ‘সতী ময়না’ ও ‘লোরচন্দ্রানী’ প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু অর্থাভাবে তাও সম্ভব হয়নি। তিনি প্রায় ছয় শতাধিক পুঁথির পরিচয়মূলক প্রবন্ধ লিখে গেছেন। এসব প্রবন্ধ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে ইতিহাস রচনার কাজ অনেকখানি সহজতর হবে। তাঁর সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলার সুধী সমাজ তাঁকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য ছিলেন। সাহিত্য, ভারতবর্ষ, নারায়ণ, মানসী, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, গৃহস্থালী, সুপ্রভাত, বঙ্গদর্শন, ভারতী, সম্মিলনী, স্বদেশ প্রেম, বিজয়া প্রভৃতি সেকালের সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই গৌরব তাঁর সমসাময়িক যুগের অপর কোন মুসলমান লেখকের পক্ষে কমই ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল ফজলের বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অধ্যাপক আবুল ফজল ‘সাহিত্য বিশারদ স্মরণে’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, “তিনি পেশাদার সাহিত্যিক ছিলেন না। সাহিত্য সাধনাকে তিনি কোনদিন অর্থোপার্জনের উপায় হিসাবে ব্যবহার করেন নি। তিনি ছিলেন খাঁটি সাহিত্য সাধক। সাহিত্যের যেখানে যা কিছু উপকরণ দেখেছেন, পেয়েছেন তাই সংগ্রহ করেছেন, প্রাণপণ যত্নে আগলে রেখেছেন যক্ষের ধনের মতো, নূতন পুরাতন যা কিছু সাহিত্য সম্পদ তাঁর হাতে পড়েছে, তাই তিনি সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন, কিছুরই অপচয় হতে দেননি। একথা বোধ করি জোর করে বলা যায়, তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থাবলীর সাহায্য ছাড়া বাংলা সাহিত্যের কোন পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হতে পারবে না। আজ ৩০ সেপ্টেম্বর। বংলা সাহিত্যের দিকপাল মুন্সি আব্দুল করিমের মৃত্যু বার্ষিকী। তাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে রইলো সাহিত্যপ্রেমীদের ফুলেল শ্রদ্ধা। বর্তমান প্রজন্ম এই মনীষীর জীবন কর্ম জানতে পারলে প্রজন্ম হবে উপকৃত।