বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১লা জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

আধুনিক রাষ্ট্রে উত্তরণের অপেক্ষায়

প্রকাশিত হয়েছে- শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
বাহাদুর ডেস্ক || ওয়েব ইনচার্জ
  • প্রকাশিত সময় : ডিসেম্বর, ১৬, ২০২৩, ৭:২১ অপরাহ্ণ

যে লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পর আমরা কি তা থেকে আরও দূরে সরে গেছি? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ কি ইতিবাচক দিকে হয়েছে? দুর্বলতা কোথায়, ভবিষ্যৎই-বা কী।

ব্রিটিশ আমলের অধীনে, ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে আমরা প্রায় দুইশ বছর কাটিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়েছিলাম। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চৈতন্যে এলো যে এই পাকিস্তান আমাদের বাঙালিদের জন্য কোনোভাবেই সত্যিকার বা সুখকর স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানের তথাকথিত জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা। সেই জিন্নাহ সাহেবের কথা থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারলাম আমরা বাঙালিরা সবদিকেই প্রতারিত হচ্ছি, এমনকি আমাদের ভাষাও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কাজেই সেই ভাষার আন্দোলনে নেমে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উপনীত হলাম এবং সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা আস্তে আস্তে এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালাম, যেখানে আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হলো। সেই সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর যে চারটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছিল সেগুলো অত্যন্ত ইতিবাচক– এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত করে যারা ক্ষমতায় এলো, তারা প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে লোপাট করে দিল এবং পাকিস্তানের ভূত যেন নতুন করে ফিরে এলো। এর পর অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও আমরা পাকিস্তানের ভূতকে আজও তাড়াতে পারি নাই। এখনও আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে বলা আছে একটা বিশেষ ধর্ম ইসলাম ধর্ম রাষ্ট্রনীতি। আবার বলা হচ্ছে আমাদের চার মূলনীতিও বজায় আছে। এই যে গোঁজামিল, এটি কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের গুণ নয়। একদিকে রাষ্ট্রধর্মও বজায় আছে আরেক দিকে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিও বহাল থাকবে– এই গোঁজামিলের কোনো অবসান যদি সামনের দিনগুলোতেও না ঘটে তাহলে আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি, এ কথা বলতে হবে।

আমরা আমাদের জনগণের মধ্যে দেখি ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। নেত্রকোনার একজন কবি লিখেছেন– হিন্দু আর মুসলমান একই গ্রন্থের দড়ি, কেহ বলে আল্লা আর কেহ বলে হরি/ বিসমিল্লা আর শ্রী বিষ্টু একই গেয়ান (জ্ঞান), দু ফাঁক করিয়া দেখি রাম রহিমান। এইভাবে হিন্দু ও মুসলমানের ভেতর যে সম্প্রীতির বন্ধনটি আমাদের লোকসমাজে বজায় ছিল, পাকিস্তান আমাদের সেই সম্প্রীতিটি নষ্ট করে দিয়েছিল। সেই নষ্টাবস্থা থেকে এখনও আমরা নিজেদের উদ্ধার করতে পারি নাই। উদ্ধার করতে পারলে আমাদের সংবিধানে এখন এর বিরুদ্ধে কিছু লেখা থাকত না। আমাদের সংবিধানকে কাটাকুটি করে যেমনটা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা, এখন ক্ষমতায় স্বাধীনতার মূল নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ দলটি থাকলেও তারা প্রকৃত প্রস্তাবে সেই স্বাধীনতার মূলনীতি ফিরিয়ে আনতে পারছে না, তা আমরা ‍দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। শুধু তাই নয়; সমাজতন্ত্র তো শুধু কথার কথায় পর্যবসিত হয়েছে। এখন সংবাদপত্রের পাতা খুললে দেখা যায়, মন্ত্রী-এমপিসহ অনেকের আয় যে হারে বাড়ছে সেটি অবিশ্বাস্য। চোখ কপালে উঠে পড়ে তাদের আয় বৃদ্ধির হিসাব দেখলে। কিন্তু তার সমানুপাতে যদি সাধারণ মানুষের আয় বাড়ত, সাধারণ মানুষ যদি খেয়েপরে বেঁচে থাকত পারত, তাহলে হিসাবটা অন্যরকম হতো। ধনবৈষম্য এত অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না পেলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে বলে আমার মনে হয়।

এই অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। পরিত্রাণ কে করবে? আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। আমাদের তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তরুণদের একটি অংশ যদিও সেক্যুলার চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি একে বাধা মনে করি না। আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রে উত্তরণপর্বেও তরুণদের একটি অংশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধশক্তি বিদ্যমান ছিল। পথের তরুণদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি আবার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে। উনিশ শতকে যাকে বঙ্গীয় রেনেসাঁস বলা হয়ে থাকে, তারই শেষ পর্বটি রিভাইভ্যালিজমের। এর প্রতিক্রিয়ায় নব উদ্ভূত মুসলিম মধ্যবিত্তের ভেতর রেনেসাঁস চেতনার বদলে রিভাইভ্যালিজমই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এই রিভাইভ্যালিজমই মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনাকে সবল করে তুলে পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু এই স্থানে মনে রাখা দরকার, রিভাইভ্যালিজমের বিপরীতে একটি সংস্কৃতি চেতনাও মুসলিম মানসে বিশ শতকের বিশের দশকে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারই প্রকাশ দেখি বেগম রোকেয়ায়, নজরুলে, শিখা গোষ্ঠী ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে। সেই ধারাটি যদি চলতে পারত তাহলে রিভাইভ্যালিজমের ধারাটি খর্ব হয়ে নবীন বাঙালি সংস্কৃতির পত্তন হতো, যেখান থেকে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারার জন্ম হতো। তরুণদের আবার এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নামতে হবে। শুরুতে তা প্রতিরোধমূলক আন্দোলন হবে। অতীতেও তারা এভাবে আন্দোলনে নেমেছিল। এ না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিন্তু ভবিষ্যৎ কখনও অন্ধকার হতে পারে না। অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ। এই আপ্তবাক্য আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। অতীতেও আমরা অনেক সংকট দেখেছি। সংকট থেকে উত্তরণও ঘটিয়েছি। আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর প্রসঙ্গ এলে অনেক কথাই বলতে হয়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর যে অধিকার ছিল, তা তারা পুরোপুরি পায় নাই এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভেতর একটা জাগরণ ঘটে গেছে বলে আমি দেখতে পাচ্ছি। সেই জাগরণের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র সত্তাগুলোর তাদের অপ্রাপ্ত অধিকার ক্রমশ আদায় করে নিতে পারবে, এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস দৃঢ়। পত্রপত্রিকায় তাদের যে সমস্ত কথাবার্তা দেখি তাতে আশাবাদী হই। তাদের ভেতর জাতিসত্তাগত সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতি হিসেবে তাদের কোন খাতগুলো লুণ্ঠিত হচ্ছে, তা তারা আবিষ্কার করছে এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে– এমন সচেতন কথাবার্তা তাদের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে। সেখানেও এমন কিছু গোষ্ঠী আছে, যারা এই জাগরণকে ভুল বিসংবাদের পথে পরিচালিত করতে চাইবে। কিন্তু সে ব্যাপারে আমিও তরুণদের বিষয়ে আস্থাশীল। আমি মনে করি, সব পথে আমাদের তরুণরা সমাজ সংস্কারে এগিয়ে এসে একটি প্রকৃত আধুনিক রাষ্ট্রে আমাদের উত্তরণ ঘটাবেন।