শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

আজ বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস ॥ নারীর ক্ষমতায়নে আইন প্রয়োজন : রাবেয়া ইসলাম ডলি

প্রকাশিত হয়েছে- শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২২
নিজস্ব প্রতিবেদক || দৈনিক বাহাদুর
  • প্রকাশিত সময় : অক্টোবর, ১৫, ২০২২, ৯:৪০ অপরাহ্ণ

‘তিনটি ওয়ার্ডের ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি; দু’বার, তবে নারী কাউন্সিলর হিসেবে বরাদ্দ পেয়েছি একজন পুরুষ কাউন্সিলরের চেয়েও কম।’ নারী কাউন্সিলরও নির্বাচনে জনসাধারণকে প্রতিশ্রুতি দেন, দিতে হয়, এসব প্রতিশ্রতি বাস্তবায়নের তেমন কোনো সুযোগ নেই স্থানীয় সরকারে। এমনটাই জানান ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর রাবেয়া ইসলাম ডলি।
তিনি আরো বলেন, নারী কাউন্সিররদের জন্য নির্ধারিত কোনো বরাদ্দ নেই, নেই প্রকল্প গ্রহণের ক্ষমতাও। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর নারী নেতৃত্বকে বিকশিত নয় বরং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।’ স্থানীয় সরকারের নীতিমালায় সংরক্ষিত মহিলা জনপ্রতিনিধিদের জন্য নির্ধারিত নীতিমালার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্পণের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম থাকা জরুরী বলে দাবি করেন এই নারী নেত্রী। এর জন্য আইন থাকতে হবে।
বিশ^ গ্রামীণ নারী দিবসে তিনি আরো বলেন, গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তাদেরকে স্বাবলম্বী করতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারীরাও বিচার পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ নারীরা পরিশ্রমী-তবে সেই শ্রমের মর্যাদা তারা পাচ্ছেন না।
দুর্যোগে পড়া ও দুর্ভোগে থাকা মানুষকে উত্তোরণে পাশে থাকেন এ নারীনেত্রী। বঞ্চিত-নিপীড়িত নারীদের জন্য রাতদিন কাজও করে যাচ্ছেন। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও যৌতুক বিরোধী কার্যক্রমেও রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা। নারীর অধিকার আদায়ে তৃণমূলে সোচ্চার সাহসী এই নারীনেত্রী। করোনাকালীন দুর্যোগে যিনি স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক সাহায্য নিয়ে ছুটেছেন ঘরেঘরে। প্রসূতী নারীর জীবন বাঁচাতে দিয়েছেন একাধিকবার রক্ত।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অগ্রযাত্রায় ঘরে-বাহিরে এবং কী! উপরে-নীচেও সমস্যায় জর্জরিত। ডলি সবসমস্যা উত্তরণের মধ্য দিয়ে কৈশোর থেকে অধ্যাবদি এগিয়ে চলছেন নিজস্ব স্টাইলে। তিনি ১৯৭৩সনের ৭ সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রফিকুল ইসলাম, পেশায় ব্যবসায়ী ও মাতা মৃত মনোয়ারা বেগম। দুই ভাই আর তিন বোনের মাঝে তিনি হলেন মেঝো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি জাগরণী পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮সনে এসএসসি ও গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ থেকে ১৯৯০সনে এইচএসসি পাস করেন। এরপর গৌরীপুর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন ১৯৯৩ সালে। তিনি স্কুল জীবনেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৮৬-৮৭সনে উচ্চ বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৮৯-৯০সনে মহিলা ডিগ্রী কলেজ কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৯১-৯২সনে গৌরীপুর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। এরপর গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন।
১৯২৭সনে স্থাপিত ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী গৌরীপুর পৌরসভায় সংরক্ষিত (১,২ ও ৩) ওয়ার্ডে ১৯৯৮সনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর পরের বছর ময়মনসিংহের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আতাউল হক মিন্টু’র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। দাম্পত্য জীবনে মেয়ে তাসমীম তাসফিয়া হক আরশি। এবার রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে মেধাতালিকায় ৬ষ্ট হয়ে এ বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৪ সনের ৮ মে যেসময় এ পৌরসভার নির্বাচন চলছিলো, ভোটাররা ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক সেই মুর্হূতে স্বামীকে হারান তিনি। তাঁর সে বছর প্রতীক ছিলো কলসী, সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তিনি এবারও নির্বাচিত হন।
এরপরে তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২০১৪সনে প্রায় ৭০হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তিনি জানান, উপজেলা পরিষদে এসে দেখলাম এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানের সমএলাকায় ভোটারদেরও ভোটে নির্বাচিত হলেও এখানেও রয়েছে বৈষম্য। উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে বলা হয় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর দেখভাল করতে, তবে বাস্তবে মহিলা অধিদপ্তরের কার্যক্রমেও হস্তক্ষেপ মুক্ত নয়। বরাদ্দের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা বা বন্টননামা নেই; যতোটুকু কৌশলে নেয়া সম্ভব, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়, প্রতিশ্রুতি দিলেও কাঙ্খিত সেবা প্রদান সম্ভব হয়না।
তিনি বলেন, প্রত্যেক নারীকে সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কথা ও কর্মে এক ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছার পর মানুষের প্রতি দায়িত্ব আর কর্তব্য সেগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, নারীদের প্রত্যেকটি কাজে ত্যাগ, কষ্ট ও প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো উত্তোরণ ঘটানোর সাহস্য-শক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই নারীরা সঠিক মূল্যায়ন পাবে।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি পথেপ্রান্তরে মানব উন্নয়নে তিনি ছুটে চলেছেন রাতদিন। শিক্ষার বিস্তারে ছুটে চলেছেন প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধেও তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি ‘ওরা ১১জন’ টিম তৈরি করেন। সেই টিমকে সহযোগিতা করা ছাড়াও গৌরীপুর উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সমাবেশ করেন। শিক্ষাঙ্গনের সামনে বিশাল ব্যানারে বাল্যবিয়ের কূফল তুলে ধরেন। ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নেও সরব ছিলেন এই সাহসী নারীনেত্রী। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্লাব সংগঠনেরও ক্রীড়া সামগ্রী প্রদান করেন। খেলাধুলার উন্নয়নে ও ক্রীড়ামোদীদের উৎসাহিত করতে খেলার মাঠে তার ছিলো সরব উপস্থিতি।
পৌর শহরের পাটগুদাম এলাকার ঋষী সম্প্রদায়ের লোকজন মাদক উৎপাদন, বিপনন ও সেবন ছেড়ে দেয়া মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। সেই পল্লীতে গিয়ে তাদেরকে মাদক সেবন থেকে বিরত থাকা ও আশপাশের লোকজনের উৎপীড়ন থেকে রক্ষায় পাশে দাঁড়ান। সুইপার কলোনীতেও পুজার বিশেষ উপহার হিসাবে বস্ত্র বিতরণ করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুল বিতরণে ছিল উপজেলায় ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন। জনপ্রিয় এই নারীনেত্রী কর্মহীন নারীদের জন্য কর্মসংস্থানে জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। শুধু প্রশিক্ষণ নয়, তাদেরকে কর্মমূখী করতে তাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ ও তদারকিও করেন। এসব নারীদের নিকট তিনি হয়ে প্রিয় ‘ডলি আপা’।
বানভাসী মানুষের মাঝে নিকটও ছুটে গেছেন এই সংগ্রামী নারী নেত্রী রাবেয়া ইসলাম ডলি। নিজের বেতনের টাকায় ত্রাণ সামগ্রী ক্রয় করে দিয়েছেন বন্যার্ত মানুষের মাঝে। সরকারি অনুদানের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত সামর্থ্য নিয়েও ছুটে চলেছেন সর্বক্ষণ। ভাংনামারী ইউনিয়নের বন্যার্তদের মাঝে তিনি নিজে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ঘরেঘরে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানির জন্য হতদরিদ্র ও অসহায় পরিবারের মাঝে নলকূপ প্রদান বিতরণ করেন। তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের মাঝে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা বিতরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রাবেয়া ইসলাম ডলি ২০১৫সালে স্থানীয় সরকারের অধিনে জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, পর্তুগাল ও স্পেনে ১৫দিন ভ্রমণ করেন। সমাজসেবা ও নারী উন্নয়নের জন্য কবি কাজী নরুরুল ইসলাম স্বর্ণপদক অর্জন করেন। নারী নির্যাতন বিরোধী কার্যক্রমের জন্য শ্রেষ্ঠ স্বজন সম্মানায় ভূষিত হন। এছাড়াও গৌরীপুর উপজেলার নির্বাচিত হন শ্রেষ্ঠ জয়ীতা।
তিনি বাংলাদেশ ভাইস চেয়ারম্যান এসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদ অলংকৃত করেন। ছিলেন উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি। এছাড়াও ময়মনসিংহ জেলা রেডক্রিসেন্টের আজীবন সদস্য। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এবার শুধু গৌরীপুর উপজেলা নয়, নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।