আজ বুধবার (১৩ নভেম্বর/২০২৪) হুমায়ুন আহমেদ’র ৭৬তম জন্মদিন। এ লেখকের স্মৃতিময় জংশনটি শতবর্ষেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগেনি। রিমডেল স্টেশনে উন্নীত হয়নি। অথচ প্রতিবছর আয় ৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জংশনের প্রত্যেকটি ভবনের পলেস্তার খসে পড়ছে, অধিকাংশ ভবনে ফাটল, ৪০বছর পূর্বে পরিত্যক্ত ঘোষিত ভবনে ঝুঁকি নিয়েই চলছে কার্যক্রম। সংস্কারকৃত নতুন লাইন সচলের আগে আবারও অচল। নতুন একটি ভবন নির্মিত হলেও রেললাইনের সংযোগ না তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে জানান স্টেশন মাস্টার অখিল চন্দ্র দাস।
এ জংশনকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁরই লেখায় এ জংশনের ভালোবাসা, মায়া, দুঃখ-কষ্টের সাথে শঠতা, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতার ‘গৌরীপুর জংশন’ যাত্রীসেবা দিয়ে শতবর্ষ অতিক্রম করেছে ২০১৭সালে। জন্মদিন উপলক্ষে আজ গৌরীপুর যুগান্তর স্বজন সমাবেশ, হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদ দিনব্যাপী কর্মসূচীর আয়োজন করেছে।
জর্জ স্টিফেনসনের ১৮২৫সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আবিস্কৃত হয় রেলপথ। আর গৌরীপুরে চালু হয় ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর। নানা বাড়ি মোহনগঞ্জ আর বাবার বাড়ি কেন্দুয়া যাতায়তে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি-বিজড়িত গৌরীপুর জংশন। এ জংশন নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ ২০০৫সালের ফেব্রæয়ারি মাসে প্রকাশ করেন ‘গৌরীপুর জংশন’ নামক বইটি। তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ইতিমধ্যে পরিদর্শন করেন গৌরীপুর জংশন। এ জংশনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে চলচ্চিত্র ‘গৌরীপুর জংশন’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
বইটিতে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটে উঠে তৎকালিন জংশনের চেহারা। তিনি শীতার্ত ভবঘুরে মানুষের করুণদৃর্শ্য ‘বজলু চটের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো’। স্টেশনের পকেটমার সম্পর্কে জয়নালের কুকৃর্তি তুলে ধরেন। খুলি, বড়বাবু, পতিতা অনুফা, ফুলীর জীবনের কষ্ট আর পুলিশের স্ব স্ব চরিত্রও তুলে ধরেন। চায়ের দোকানের পরিমল দা দোকানের কাজের ছেলেটিকে গরম কুন্তি নিয়ে ছ্যাঁকা দেয়ার নিষ্ঠুর ঘটনাটির বর্ণনাও রয়েছে। পুলিশের তদন্ত বলতে জয়নালের ভাষায় তুলে ধরেন ‘সত্যি বললেও গুঁতা, মিথ্যা বললেও গুঁতা। রেলওয়ে জংশনে কথা হয় ঈশ্বরগঞ্জ কৃষি ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার কবি আওলাদ হোসেন জসিম এর সঙ্গে। তিনি বলেন, হুমায়ুন আহমেদ চিরন্তন সত্য কথাগুলো গল্পের ছলে সহজ ভাষায় ফুটে তোলে ছিলেন। তাই তরুণ প্রজন্মকে বইয়ের ঘরে নিতে পেরে ছিলেন। হুমায়ুন আহাম্মেদের গৌরীপুর জংশন বই সম্পর্কে সাংবাদিক ম. নূরুল ইসলাম জানান, তিনি একজন গল্পকার, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার এর চেয়েও আমার কাছে মনে হয় তিনি একজন বিবেকবান সাংবাদিক ছিলেন। তাই অকপটে জংশনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
চায়ের দোকানী, পুলিশ, কুলি, পতিতা, পকেটমারের প্রত্যেকের বিচিত্র আচারণের সরল ব্যাখা রয়েছে গৌরীপুর জংশন নামক বইটিতে জানালেন, গৌরীপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোঃ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ফকির জানান, প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচারণ ভবঘুরে মানুষের করুণ পরিণতির কথা বুঝাতে ‘চটের ভিতরে বজলু’ উল্লেখ করেন। “গৌরীপুর জংশন”এর প্রধান চরিত্র জয়নাল। সে গৌরীপুর স্টেশনের মধ্যবয়সী কুলী, তবে ‘এখন যার দশা কোমর-ভাঙা কুকুরের মতো’। জয়নাল বর্ণিল একটি চরিত্র।
বর্ণিল চরিত্রের সেই জংশনের কার্যক্রম চলছে ৪০বছর ধরেই পরিত্যক্ত ভবনে। বছরের পর বছর রঙ মেখে আর দেয়ালে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে কর্তৃপক্ষ দায়সারেন। পুরো স্টেশন এলাকা পরিণত হয়েছে ডাস্টবিনে। রয়েছে টিকেট কালোবাজারীর অভিযোগ। যাত্রীরা চরম দুর্ভোগেরও শিকার হচ্ছেন।
সরজমিনে দেখা যায়, বুকিং কাউন্টারের ছাদের পলেস্তার ধসে পড়েছে। যাত্রীদের জন্য নির্মিত মুসাফিরখানায় পানি পড়ে। যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগারটিও ঝুঁকিপূর্ণ। রেলওয়ে ফাঁড়ির ছাদের পলেস্তার খসে পড়ছে, ভিমেও ফাটল। ভাঙা অংশে বারবার চরছে রং আর সিমেন্টের পট্টিমারা কাজ। ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে ১৯৮০সনে প্রকৌশল বিভাগ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। সেই সাইনবোর্ডও এখন কোথায় খোঁজে পাওয়া যায়নি। রেলস্টেশনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাও অচল। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীরা চরম দূর্ভোগে পড়ছেন। উত্তরপাশে নির্মিত টয়লেটটি স্টেশন থেকে প্রায় ২শ গজ দূরে, রাতে-দিনে সেখানে যাওয়া মানেই ছিনতাইকারীদের কবলে নিঃস্ব হওয়া। প্লাটফরমের বিভিন্ন অংশে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। গৌরীপুর জংশন ময়মনসিংহ, জারিয়া, মোহনগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মোহনা। জারিয়া-মোহনগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে যেতে-আসতে এখানে ট্রেন পরিবর্তন করতে হয়। চট্টগ্রাম-ভৈরবের ময়মনসিংহগামী ট্রেনের ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হয়। ঢাকাগামী আন্তঃনগর হাওড় এক্সপ্রেস, আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, বেসরকারিভাবে পরিচালিত মহুয়া এক্সপ্রেস, বলাকা এক্সপ্রেস, বন্দরনগরী চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর বিজয় এক্সপ্রেসসহ দৈনিক ৩০টি ট্রেনের যাত্রী উঠানামা করে।
গৌরীপুর স্টেশনকে ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার টিকেট বিক্রি হচ্ছে এ স্টেশনে। তবে ১ম শ্রেণির বিশ্রামাঘারে নেই পানির ব্যবস্থা। ভবনের চারপাশেই ফাটল, অধিকাংশ সময় ঝুলে তালা। দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগারও বসার অনুপযোগী। বাহিরে শত শত যাত্রী অপেক্ষা করলেও বসার ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে গাছতলা বা রেললাইনের ওপরে বসেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। স্টেশন জুড়ে এখন ময়লাস্তুপ-আবর্জনার স্তুপে ঢাকা পড়ছে রেললাইনও। দুর্গন্ধে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর। জনবল সংকটে যাত্রী সেবার মান শূন্যের কোটায়।
এ দিকে হুমায়ুন আহমেদ রচিত ‘গৌরীপুর জংশন’ বইটি বহু ভাষায় প্রকাশিত হওয়ায় বিখ্যাত বই এর গল্পের মিল খোঁজে অনুসন্ধানী ভ্রমণপিয়াসুরা আসছেন এ জংশনে। ইব্রাহীম খাঁ পুন্য স্মৃতিতে উৎসর্গ করা বইটিতে লিখে ছিলেন, আমি আমার গ্রন্থের নামকরণে অনেকবার কবিদের কাছে হাত পেতেছি। এবার হাত পাতবার আগেই নাম পেয়ে গেলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণ পান্ডুলিপি পড়ে নাম দিলেন ‘গৌরীপুর জংশন’। তাঁকে ধন্যবাদ।
গল্পে স্টেশনে সবার স্বার্থপরতা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান, কিন্তু অনাথ শিশু বজলুর জন্য দয়াময় একটি মনও ছিল জয়নালের। মালবাবু আর সিগনাল-ম্যান রমজানের সাথে তার বেশ খাতির। নানান সময়ে তারা জয়নালকে নানানভাবে সাহায্য করেছে, জয়নাল এ সত্যটা কখনো ভুলতে পারে না, তাদের জন্য কিছু করার চিন্ত সবসময় তাকে ঘিরে থাকে। জয়নালের চরিত্রে অসদগূণগুলো তার নানা কর্মকাÐে প্রকাশ পায়। স্টেশনের পুরনো সর্দার মোবারককে নিগৃহীত হতে দেখে আনন্দ পায়, পুলিশকে মোবারকের নাম বলে দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। কুলী-গিরি ছাড়ার পর মূলত চুরি করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছে সে। ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে চুরি করা ছাড়াও স্টেশনের মালবাবুর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ফেরত দেয় না সে। হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই ছিঁচকে চোরের চরিত্র বর্ণনা করেন।
হুমায়ূন তাঁর স্বভাবসুলভ নিস্পৃহ-নিম্নকণ্ঠে এঁকে গেছেন এই বড় কাঠামোর নিখুঁত ফর্দ। ইট-কাঠ-পাথরের অবকাঠামোটিকে প্রাণ দিয়েছেন মানুষের স্পর্শে। জায়গাটা রেলস্টেশন হওয়ায় চলমান ট্রেন আর দ্রæত সঞ্চরণশীল মানুষসকল তাদের আবছা মুখ নিয়ে হাজির হয়েছে ক্ষণিকের জন্য। আবার ট্রেন চলে যাওয়ার পরও যে চলিষ্ণুতা স্টেশনকে জমিয়ে রাখে, তার মূর্তিও অঙ্কিত হয়েছে। উৎপাদন আর বিলি-বণ্টনের ব্যাপারে লেখক পর্যাপ্ত পরিমাণে সজাগ ছিলেন। ক্ষমতার বিচিত্র ধরনও তাঁর বিবেচনায় ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, স্টেশনের উৎপাদনব্যবস্থা আর ক্ষমতা-সম্পর্কের নিরিখে মানুষগুলোর আচার-আচরণ নিরূপিত হয়েও ব্যক্তির বিশিষ্টতা মোটেই ক্ষুন্ন হয়নি। নিপুণ গল্প-বলিয়ে হুমায়ূন জংশনের এই নাতিদীর্ঘ গল্প বলায়ও বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তবে অনেকটাই বদলে গেছে আজকের গৌরীপুর জংশন।
শতবর্ষে এ স্টেশনের নতুন একটি ভবন হয়েছে। যার সঙ্গে রেললাইনের কোন সংযোগ নেই। নতুন ভবনও অচল। দু’টি লাইন সংস্কার ও মেরামত করা হলেও তার একদিনের জন্যও সচল হয়নি। গচ্ছা এ বিভাগের প্রায় ৩৮লাখ টাকা। যাত্রীদের বিশ্রামের স্থানসহ রেলওয়ে জংশনের সিংহভাগ অবৈধ দখলদার আর লীজওয়ালাদের দখলে। রেললাইনের উপরেও বসেছে দোকানপাট। হুমায়ুন আহমেদ এর বই’র পাতার বর্ণনায় এক নজর গৌরীপুর জংশনকে দেখতে বাড়চ্ছে পর্যটকদের ভিড়।