শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

৭১’র রণাঙ্গনের সেই অন্যতম যোদ্ধা মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদের আজ জন্মদিন

প্রকাশিত হয়েছে- সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১
||
  • প্রকাশিত সময় : জুলাই, ১২, ২০২১, ৮:৪০ অপরাহ্ণ

 

মোখলেছুর রহমান, স্টাফ রিপোর্টারঃ
কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদের জন্মদিন আজ।

ঢাকার ধনী পরিবারের ছেলে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ। তখনকার দিনে এলভিস প্রিসলির গান শোনার জন্য এক ধাক্কায় ১ হাজার টাকার রেকর্ড কিনে আনতেন। তাঁদের বাড়িতে হরিণ ছিল, সরোবরে সাঁতার কাটত ধবল রাজহাঁস, মশলার বাগান থেকে ভেসে আসত দারুচিনির গন্ধ। (ডাকে পাখি খোলো আঁখি/ দেখো সোনালি আকাশ/ বহে ভোরের বাতাস) এই গানের শুটিং হয়েছিল তাদের বাড়িতে)।
১৯৬০ এর দিকে আজাদ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়েন। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করবেন। আজাদের মা বললেন, “তুমি বিয়ে করবে না, যদি করো- তাহলে আমি একমাত্র ছেলে আজাদকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব।” আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করলে আজাদের মা সাফিয়া তার বালকপুত্রের হাত ধরে ওই রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করেন এবং একটা পর্ণকুটীরে আশ্রয় নেন। ছেলেকে লেখাপড়া শেখান।
আজাদ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন।
তাঁর বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেছে। তারা ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করে। বন্ধুরা আজাদকে বলল- “চল বন্ধু আমাদের সাথে, অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পিস্তল চালাতে জানিস। তোর আব্বার তো বন্দুক আছে, পিস্তল আছে, তুই সেগুলো দিয়ে অনেকবার শিকার করেছিস।”
আজাদ বলল, “এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি।”
মাকে আজাদ বলল- মা, আমি কি যুদ্ধে যেতে পারি?
মা বললেন- “নিশ্চয়ই, তোমাকে আমার প্রয়োজনের জন্য মানুষ করিনি, দেশ ও দশের জন্যই তোমাকে মানুষ করা হয়েছে।”
আজাদ যুদ্ধে গেল। দুটো অপারেশনে অংশ নিল। তাদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হলো। গেরিলারা আশ্রয় নিল।
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট, ক্র্যাক প্লাটুনের একদল সাহসী মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সেসময় আজাদকেও আটক করা হয়। তাকে ধরে নিয়ে রাখা হলো রমনা থানা সংলগ্ন ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে।
গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আজাদকে তাঁর মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।
–“মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।“
–“বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
–′′না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই।”
–′′বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
–′′আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।”
–′′আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।”
সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে! এভাবে!

মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে পরদিন সারারাত রমনা থানায় দাঁড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট-সব জায়গায় খুঁজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না।
ছেলে একবেলা ভাত খেতে চেয়েছিলেন। মা পারেননি ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে। সেই কষ্ট-যাতনা থেকে পুরো ১৪টি বছর ভাত মুখে তুলেন নি মা। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন ১৪ টা বছর ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। বিশ্বাস ছিলো তাঁর আজাদ ফিরে আসবে। ছেলের অপেক্ষায় শুধু ভাতই নয়, ১৪বছর তিনি কোনো বিছানায় শোন নি।
শনের মেঝেতে শুয়েছেন। শীত গ্রীষ্ম কোনো কিছুতেই তিনি পাল্টান নি তার এই পাষাণ শয্যা। আর এর মুল কারণ আজাদ রমনা থানায় আটককালে বিছানা পায় নি।

৩০ আগস্ট রাতে রুমী, আবু বকরদের মতো আজাদকেও রাজাকারদের সহযোগিতায় ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে পাকিস্থানী আর্মিদের দ্বারা অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয় বকর, রুমি, বদিসহ সাতজন । নাক-মুখ ফেঁটে রক্ত বের হচ্ছে, কোটর থেকে চোখ খুলে এসেছে, হাড়গোড় ভেঙ্গে দিয়েছে, অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছে, এতকিছু সয়েও ওঁরা একটিবারের জন্যেও মুখ খুলেনি ।
এরপর ওদের ভাগ্যে কি ঘটেছে কেউই জানেনা।

.তথ্য সূত্র – মা/ আনিসুল হক ।