বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক সাংবাদিক গোলাম সামদানী কোরায়শী আজ ৯৩তম জন্মোৎসব

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০২২
শ্যামল ঘোষ || উপজেলা প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ৫, ২০২২, ৮:০৪ অপরাহ্ণ

সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, অনুবাদক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক গোলাম সামদানী কোরায়শী আজ মঙ্গলবার (৫এপ্রিল/২০২২) ৯৩তম জন্মোৎসব। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের বীরআহাম্মদপুর গ্রামে।
তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, গান লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বলা যায়, একদিকে তার অনুবাদ কর্ম, প্রবন্ধ এবং সিমেটিক মিথভিত্তিক উপন্যাসগুলো আমাদের সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে; সাথে যোগ হয়েছে অন্যান্য অনুষঙ্গ।
তিনি নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে একবছরে পাঠ চুকিয়ে চলে আসেন গৌরীপুরে। এরপর মাদরাসা শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত হন। মাদরাসায় তিনি মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। মাদরাসার ছাত্রজীবনে তিনি মাঠে রাখালের কাজ করেন। সেই রাখাল ছেলেটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ধর্মকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত টাইটেল পাশ মৌলানা থেকে যাঁর উত্তরণ ঘটলো একজন ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তবুদ্ধির মানুষে, আরজ আলী মাতুব্বর থেকে জ্যাঁ পল সার্ত্রে, এঁদের কাতারে দাঁড়িয়ে যিনি উপলদ্ধি করলেন জীবনকে, এরকম একটি জীবনের বিকাশ বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায় ‘সিন্দুর এক বিন্দু’তে। মানুষের মুক্তিচিন্তায় জীবন উৎসর্গ করে গেছেন এই বীরযোদ্ধা।
তার জন্মোৎসব পালন উপলক্ষে গৌরীপুর লেখক সংঘ, ভূটিয়ারকোনা আদর্শ গণপাঠাগার ও যুগান্তর স্বজন সমাবেশ নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
তিনি কেন্দুয়া উপজেলার কাউরাটে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩০সনের ৫এপ্রিল। বাবার নাম মৌলভী বাবু শেখ আবু আছল মোঃ আব্দুল করিম কোরায়শী আর মায়ের নাম আলতাবেন্নেছা। সহধর্মিণী সায়িদা কোরায়শী। দাম্পত্য জীবনে ছিলেন ৫ পুত্র ও ২ কন্যার জনক। ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আগ্রহে তিনি ১৯৬১সনের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান রচনায় সহকারি সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৮সনে তিনি ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।
তাঁর ১ম অনুবাদ গ্রন্থ ‘কালিলা ও দিমনা’ এরপরে ইবনে খালদুন-এর আল-মুকাদ্দিমা (১ও ২খন্ড), হেজাজ-এর সওগাত ও তারিখ-ই-ফিরোজশাহী অনুবাদ করেন। ‘কালিলা ও দিমনা’ : মূল ফার্সি, হুসায়ন আল কাশেফের ‘আনোয়ারে সুহায়েল’। প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৯৬৫); ‘হেজাজের সওগাত’ : মূল ফার্সি মহাকবি ইকবালের ‘আরমুগানে হেজাজ’, কাব্য। প্রকাশক : ইকবাল একাডেমি (১৯৬৫); ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ : মূল ফার্সি, জিয়া উদ্দিন বারানী। প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৯৮২); ‘তোফা’ : মূল ফার্সি, শায়ুখ ইউসুফ গদা-এর ‘তুহফা-ই-নসাঈহ’। প্রকাশক বাংলা একাডেমি; ‘আল-মুকাদ্দিমা’: মূল আরবি, ইবনে খলদুন-এর ‘কিতাবুল ইবার’ প্রকাশক বাংলা একাডেমি (দুই খণ্ড ১৯৮১ ও ১৯৮২); ‘আইন আদালতের ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দ’ : মূল ইংরেজি, ও’ জন বার্নস, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭১); ‘অশাস্ত্রীয় পুরাণ’ : মূল ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭১); ‘শব্দাদর্শ অধ্যয়ন’ : মূল মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭২); ‘আমার অভিযোগ’ : প্রবন্ধ, মূল উর্দু, সাদাত হাসান মান্টোর ‘মুঝে ভি শেকায়েত নেহী’ : প্রকাশক : জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, ঢাকা (১৯৬৫); ‘ফতেহাবাদের আউলিয়া কাহিনী’; মূল সৈয়দ ইনায়েত হুসাইন রিযভী, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৬৮) ইত্যাদি।
এছাড়াও তিনি বেশকিছু অনুবাদ করেছেন, যেগুলো বিভিন্ন সাময়িকী এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাদাত হাসান মান্টোর ছোটগল্পের নাট্যরূপ : ভেজাল; যা নাসিরাবাদ কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত (১৯৭৮); ফার্সি রস রচনা : ‘চাটনি’ : সাপ্তাহিক ময়মনসিংহ বার্তা জেলা বোর্ড কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত; ইত্যাদির নাম।
এসব গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম ছাড়াও তিনি লিখেছেন কয়েকটি সেমিটিক মিথোলজি নির্ভর উপন্যাস; স্বর্গীয় অশ্রু (১৩৮০), মহাপ্লাবন (১৩৮৩), পুত্রোৎসর্গ (১৩৮৩) ইত্যাদি। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ : আরবি সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত); সাহিত্য ও ঐতিহ্য (মুক্তধারা ১৯৮১); ইসলাম ও আমেরিকা (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী), ঐতিহ্য অন্বেষা, পিতৃভাষা, আসামির কাটগড়ায়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম নামে সংকলিত প্রবন্ধ, স্বর্গীয় অশ্রু, চন্দ্রাতপ নামে উপন্যাস প্রকাশিত হয়। গবেষণামূলক গ্রন্থ তোহফা-এর অনুবাদ ও সম্পাদনা, ‘টাপুর টুপুর’ এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। বিরুদ্ধ সময়ে তিনি রচনা করেছেন ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের বই (১৯৯০-এ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত)। লিখেছেন ‘ছোটদের দুদুমিয়া’র সংগ্রামী জীবনকথা (১৯৯০-এ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত)।
তার রচনার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ- আত্মজীবনী : সিন্ধুর এক বিন্দু। আত্মজীবনীতে তার জীবনের উত্থান-পতন, জীবন সংগ্রামের নিবিড়তম প্রিয়-অপ্রিয় নানান বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। আত্মজীবনী সিন্ধুর এক বিন্দু তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছে পাঠককুলকে। তবে আত্মজীবনীতে তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯১-এর ১১ অক্টোবর, মৃত্যু পর্যন্ত সময়টার বর্ণনা লিখে যেতে পারেননি। কিন্তু অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীতে যে আলোর দিশা রেখে গেছেন তাও পাঠককে ঋদ্ধ করবে। আত্মজীবনীমূলক অসমাপ্ত রচনা ‘সিন্ধুর এক বিন্দু’ ২০০০সনে সূচীপত্র প্রকাশন প্রকাশ করে।
প্রবন্ধ-উপন্যাস-শিশু সাহিত্য প্রভৃতি মৌলিক রচনা সমূহে ছড়িয়ে দিলেন মূল্যবান চিন্তাধারা-এভাবে বিদ্যাজগতে তাঁর কর্ম অধিষ্ঠান। বুদ্ধিজীবি সংগ্রাম শিবির (মুক্তিযুদ্ধকালীন) সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সহ অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নেতৃত্বের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তিনি ১৯৫০সনে কুমারদী মাদরাসা সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৫৪সনে এম.এ. কামিল পরীক্ষায় স্বর্ণপদক, ১৯৮৭সনে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৯০সনে অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৭সনে স্বাধীনতা পুরস্কার, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সদস্য ও সাহিত্যে অবদানের জন্য সাহিত্য পদক ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।
ময়মনসিংহের জীবনে তিনি গ্রামের বিচার সালিশ থেকে শুরু করে কবরস্থান প্রতিষ্ঠার কাজেও নিজের সময় ব্যয় করেছেন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যাপিত জীবনের প্রতিদিন মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। ১৯৯১সনের ১১ অক্টোবর তিনিব মৃত্যু বরণ করেন।