শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক যতীন সরকারের আজ ৮৭তম জন্মদিন

প্রকাশিত হয়েছে- বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২২
সেলিম আল রাজ || সহ-সম্পাদক, দৈনিক বাহাদুর
  • প্রকাশিত সময় : আগস্ট, ১৮, ২০২২, ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ

আজ শিক্ষাবিদ-গবেষক-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক লেখক অধ্যাপক যতীন সরকারের ৮৭তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে যুগান্তর স্বজন সমাবেশের উদ্যোগে কেককাটা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এছাড়াও গৌরীপুর গণপাঠাগার ও নেত্রকোনা ও কেন্দুয়ায় এ মনিষীর জন্মদিন উদযাপিত হবে।
তিনি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে ১৮ আগস্ট ১৯৩৬সালে জন্ম গ্রহণ করেন। সর্বোচ্চ রাষ্টীয় সম্মাননা ২০১০সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ও ২০০৭সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।
তিনি ১৯৪৩সাল থেকে ৪৬সাল পর্যন্ত রামপুর ফ্রি বোর্ড স্কুলে অধ্যয়ন করেন। ৫ম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার পারুলতলার হাতিল গ্রামে মামার বাড়িতে চলে আসেন। প্রচণ্ড দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেই এগিয়ে চলেন অধ্যাপক যতীন সরকার। ১৯৪৮সালের ফেব্রুয়ারিতে নেত্রকোনা সদরের নামকরা বিদ্যাপীঠ চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে ভর্তি হন। পুকুরিয়া গ্রামের বাপের জ্যাঠাতো বোনের বাড়িতে থেকে এ স্কুল অধ্যয়ন করেন। সেখানে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুভাগ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সদ্য গঠিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিরূপতায় পিসিমায়ের ছেলেরা কুচবিহারে চলে গেলে তাঁকে আবার পাশের গ্রামের বেখৈরহাটি স্কুলে ফিরে আসতে হয়। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এ স্কুলে পড়ালেখা করেন যতীন সরকার। ১৯৫০সালে দাঙ্গায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ৮ম শ্রেণির পড়া শেষ করেই ১৯৫১ সালে রামপুর থেকে আড়াই মাইল দূরে আশুজিয়া হাইস্কুলে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে আশুজিয়া স্কুল থেকে মেট্টিক পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও দুরারোগ্য পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ায় মেট্টিক পরীক্ষা দেন ১৯৫৪সালে।
যতীন সরকারের বাবা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকারের হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি ছাড়া অন্যকোন আয়ের উৎস ছিল না। তাঁদের গ্রাম চন্দ্রপাড়ার পার্শ্ববর্তী দলপা ও নন্দীগ্রাম ছিল মূলত হিন্দু অধ্যুষিত। পাকিস্তান হওয়ার পরপর ওই এলাকার লোকজন ব্যাপক হারে ভারতে চলে যেতে থাকায় তাঁর পিতার ডাক্তারি পেশায় মন্দাভাব দেখা দেয়; তাঁর পরিবার দারুণ আর্থিক দৈন্যের মধ্যে পড়ে। ফলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তাকে পরিবারের পোষণের দায়িত্ব নিতে হয়। এ জন্য রামপুর বাজারে চাটাই বিছিয়ে ডাল, ম্যাচ, বিড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি বিক্রি করে সংসারে প্রতিদিনের খরচের যোগান দিতে থাকেন।
১৯৫৪সালে মেট্টিক পরীক্ষা দিলেও আই.এ ভর্তির টাকা যোগাড় করার জন্য তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। টিউশনি করে টাকা জমিয়ে ১৯৫৫ সালে আইএ’তে ভর্তি হন নেত্রকোনা কলেজে। এবারও তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় লজিং বাড়িতে। কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬সালে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি যে পরিবারে লজিং থাকতেন, সে পরিবারও দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হওয়ায় তাদের অভাবের সংসারে সীমিত অর্থের যোগান দিতেন, অনেকদিন তাদের সাথে অনাহারেও থাকতেন। নেত্রকোনা কলেজ থেকে আইএ পাশের পর ১৯৫৭সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। এবারও তাঁর ঠিকানা ময়মনসিংহ শহরের লজিং বাড়ি। ১৯৫৯ সালের বিএ পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষকতা শুরু করেন আশুজিয়া হাইস্কুলে। পাস করার পর বারহাট্টা হাইস্কুলে ১৯৬১সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। তখনই ছাত্র হিসাবে পান বর্তমানে দেশবরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ-কে। এরপরে এম.এ পড়ার জন্যে চলে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েই ১৯৬৩সালের অক্টোবরে গৌরীপুর আর.কে হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। শিক্ষক হিসেবে এখানে তাঁর স্থিতিকাল মাত্র ১০মাস। এরপর বাংলার শিক্ষক হিসাবে ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন এবং এখানেই ২০০২সনে কর্মজীবনের সমাপ্তি হয়।
প্রায় ৫০বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। সেটি ছিল ১৯৮৫সাল। বাংলা একাডেমি ১৯৮৬সালে প্রকাশ করেন ‘বাংলাদেশের কবিগান’ গ্রন্থটি। হাক্কানী পাবলির্শাস বের করে ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ইউপিএল থেকে বের হয় ‘বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’। শিশুদের জন্য সুপাঠ্য ব্যাকরণগ্রন্থ ১৯৯৪সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’। তাঁর লেখা ৪টি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। সেগুলো হল ‘কেদারনাথ মজুমদার’, ‘চন্দ্রকুমার দে’, ‘হরিচরণ আচার্য’, ‘সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী’।
মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার, আমাদের চিন্তাচর্চার দিক-দিগন্ত, রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ক কথাবার্তা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূত ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, ভাষা সংস্কৃতি উৎস নিয়ে ভাবনা চিন্তা, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, সত্য যে কঠিন, আমার রবীন্দ্র অবলোকন, ব্যাকরণের ভয় অকারণ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের কয়েকটি মাত্র। সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’, প্রসঙ্গ ঃ মৌলবাদ, জালালগীতিকা সমগ্র। তিনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাবেক সভাপতি এবং ত্রৈমাসিক সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পত্রিকার সম্পাদক।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনবদ্য আত্মজীবনী পাকিস্তানের জম্মমৃত্যু-দর্শন প্রথম আলো বর্ষসেরা-১৪১১ বই হিসাবে পুরস্কৃত হয়। প্রথম লেখার জন্য তরুণ লেখক হিসাবে ১৯৬৭সালে বাংলা একাডেমির ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক পান। ১৯৯৭সালে নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ তাঁকে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনির উদ্দিন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৮সালে শ্রুতি স্বর্ণপদক, ২০০১সালে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০০৮সালে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও আমরা সূর্যমুখীর সম্মাননা পান। ২০০৯সালে পান ছড়াকার আলতাফ আলী হাসু পুরস্কার। ২০১৫সালে গৌরীপুর যুগান্তর স্বজন সমাবেশের ‘দৈনিক যুগান্তর সম্মাননা’ এবং একই বছরে আমিন জুয়েলার্স সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়াও নেত্রকোনা উদীচী, ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, কেন্দুয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেন।