শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪ -|- ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০-বসন্তকাল -|- ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সুরে সুরে ইসলামের বার্তা ছড়ান তুরস্কের ‘মেসুত কুর্তিস’

প্রকাশিত হয়েছে- সোমবার, ৯ মার্চ, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : মার্চ, ৯, ২০২০, ৭:৪০ অপরাহ্ণ

বাহাদুর ডেস্ক :

‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়/আমার নবী মোহাম্মদ, যাহার তারিফ জগৎময়। আমার কীসের শঙ্কা, কোরআন আমার ডঙ্কা/ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।’ – কাজী নজরুল ইসলাম

মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে গান, মিউজিক, হামদ, নাত, গজল ও ভজনে গভীর সম্পর্ক আছে। এগুলো মানুষের মস্তিষ্ককে গভীরভাবে আন্দোলিত করে। কারণ সুর মানব মনের বা মনোজগতের একটি অংশ। এটা অধিকাংশ মানুষের অন্তরে প্রশান্তি দেয়।

আর ইসলামী সঙ্গীতের জগতে ডুব দিতে যারা ভালোবাসেন, তারা তো অবশ্যই ‘মেসুত কুর্তিস’ নামক এক কন্ঠশিল্পীকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। বর্তমান সময়ে ইসলামী সঙ্গীতের জগতে সফল পদচারণা যাদের তাদের তালিকার প্রথম দিকেই রাখা যায় মেসুত কুর্তিসের নাম।

তিনি তার চমৎকার কণ্ঠের সুরমাধূর্য্য দিয়ে ইসলামী সঙ্গীতের শ্রোতাদের হৃদয়ে নিজের নামটি সযত্নে খোদাই করে নিয়েছেন।

মেসুত কুর্তিসের গানকে বলা যায় আল্লাহ এবং প্রিয় নবীজী হযরত মুহাম্মদের (সা.) প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার মহিমান্বিত প্রকাশ। ইসলামের আলোয় আলোকিত পরিবেশে লালিত হওয়া কার্তিসের গানে ইসলামের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামী সঙ্গীতের সুপরিচিত এই শিল্পীকে নিয়েই আজকের এই ফিচার।

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ মেসিডোনিয়া। মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কপিয়েতে ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে জন্ম নেন তুর্কি বংশোদ্ভুত শিল্পী মেসুত কুর্তিস। তার পরিবারের পরিবেশ ছিল ধর্মীয় ভাবগাম্ভীযপূর্ণ। দাদা ও বাবা ছিলেন ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত জ্ঞানীজন।

মেসুতের পারিবারিক ঐতিহ্যও বেশ সমৃদ্ধ। তার শরীরে একইসঙ্গে বইছে আলবেনিয়ান ও তুর্কি রক্ত। তার মা আলবেনিয়ান পরিবারের মেয়ে। কিন্ত তিনি পড়াশোনা করেছেন তুর্কি স্কুলে।

মেসুতের বাবার রক্তেও রয়েছে বিচিত্র সংমিশ্রণ। তার দাদা আলবেনিয়ান বংশোদ্ভুত হলেও পড়াশোনা করেছেন তুরস্কে। সেই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত এক মাদরাসায়। তিনি মেসিডোনিয়ার প্রাণকেন্দ্র স্কপিয়েতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সেই ছোটবেলা থেকেই মেসুত কুর্তিস মনমুগ্ধকর ও চমৎকার ভাবে গান গাইতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মিশতেন, খেলতেন, গান গাইতেন। তার আশেপাশের লোকেরা জানতো তার গানের গলা দারুণ।

তুর্কি ঐতিহ্যের একটা অংশ হলো বিশেষ কোন ধর্মীয় দিবস (যেমন- লাইলাতুল ক্বদর) হৈচৈ করে উৎযাপন করে সেটাকে উৎসবে রূপ দেয়া হয়। মসজিদে শাইখদের খুতবার পরে ইসলামী গানের আয়োজন থাকে।

একবার এমনি এক অনুষ্ঠানে সাত-আট বছরের ছোট্ট কুর্তিস মজলিসের পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চাচা এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন মজলিসের একেবারে সামনে। তাকে বললেন একটা নাশিদ গেয়ে শোনাতে। তিনি গাইলেন। সেই শুরু। তারপর থেকে নানান দলের সাথে বিভিন্ন মসজিদে নাশিদ গেয়ে বেড়াতেন তিনি। মেসিডোনিয়ার বাইরে আশেপাশের দেশগুলোতেও বিভিন্ন নাশিদ গ্রুপের সাথে নাশিদ গাইতে যেতেন।

মেসুত কুর্তিস যখন বালক, তখন তিনি বিভিন্ন দলের সঙ্গে গান করতেন। দলের সদস্যরা সকলেই ছিল তার থেকে বয়সে বড়। তিনি অবলীলায় তাদের সাথে মিশতেন, যেন কোন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন। পরে যখন ফিরে যেতেন তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের কাছে, তাদেরকে নিজের তুলনায় অপরিপক্ক মনে হতো।

মেসুত এমন কারো সঙ্গে মিশতে চাইতেন যার থেকে তিনি কিছু শিখতে পারবেন। সবসময় নতুন কিছু শেখার জন্য উন্মুখ থাকতেন। পরিবারের পরিবেশও ছিল তার আগ্রহের পক্ষে। বাবা ও দাদা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। ক্ল্যাসিক্যাল আরবীতে তাদের দারুণ দখল ছিল।

কুর্তিসের আরবী ভাষার প্রতি ভালোবাসা এভাবে পরিবার থেকেই পেয়েছেন। তার বাবা ও দাদা ক্লাসিক আরবি শিল্পী উম্মে কুলসুম ও আব্দেল হালিম হাফিজ শুনতেন।

সাইয়্যিদ নকশবন্দীর নাশিদ ও কবিতাও তারা পছন্দ করতেন। ছোটবেলায় কুর্তিস কিছু না বুঝেই সেইসব গুরুগম্ভীর কথাগুলো মুখস্থ করতেন। কলেজ পাশ করার পর পড়াশোনা করতে তিনি পাড়ী জমান যুক্তরাজ্যে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলস থেকে ইসলামী আইনশাস্ত্রে (শরীয়া) ডিগ্রী নেন। এছাড়া ভাষা শেখায় তার দারুণ দক্ষতা আছে। তিনি পাঁচটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন।

তিনি যখন ওয়েলস ইউনিভার্সিটির ছাত্র, তখন বিখ্যাত নাশিদ রেকর্ড কোম্পানী ‘Awakening recods’-এর নজরে পড়ে তার সঙ্গীত প্রতিভা। তিনি Awakening record-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ২০০৪ সালে Awakening records-এর ব্যানারে প্রকাশিত হয় প্রথম অ্যালবাম ‘Salawat’।

এই অ্যালবামের সঙ্গীত আয়োজন করেছিলেন বিখ্যাত নাশিদ শিল্পী সামি ইউসুফ। এমনকী এই অ্যালবামের একটা গানে সামি ইউসুফকে ফিচার করা হয়। ‘O Allah’ নামের এই গানটিতে একসঙ্গে গেয়েছেন সামি ইউসুফ ও মেসুত কুর্তিস।

অভিষেক অ্যালবাম শ্রোতামহলে বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই অ্যালবামে রাখা হয়েছে সুফী ইমাম বুসাইরির বিখ্যাত ‘Qasidat Al Burdah’।

মেসুত কুর্তিস যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ‘Islam channel’-এর প্রোগ্রাম Saturday Night -এর একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এই নাশিদ এমনকী আমার চেয়েও বেশী জনপ্রিয়’। এরপর ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় অ্যালবাম Beloved। এরপর ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় এবং সর্বশেষ অ্যালবাম Tabassam।

আরবী তাবাসসাম অর্থ হাসি। হতাশা আর দুশ্চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে নবীজীর সুন্নাত অনুসারে সবসময় হাসার কথার বলা হয়েছে নাশিদটিতে।

‘দ্য ন্যাশনাল’ পত্রিকায় দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি সাধারণত ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি দেখেছি আজকালকার মুসলিম সমাজে অনেক সুন্নাহই অবহেলিত যার মধ্যে বড় একটি হচ্ছে হাসি। অথচ নবীজী সবসময় হাসিমুখে থাকতেন। নবীজী বলেছেন, ‘মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলাও সাদাকা।’ আমি এই অ্যালবামে এই শিক্ষাটির প্রতি গুরুত্বারোপের চেষ্টা করেছি।

মেসুত কুর্তিসের গানের কথা সাধারণত তিনি না লিখে পেশাদার গীতিকারকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। তবে সুর এবং গানের আইডিয়া হয় তার নিজের। কিন্তু Tabassam অ্যালবামের ১২ টি গানের ছয়টি তিনি নিজেই লিখেছেন।

এই অ্যালবামে তাই গীতিকার হিসেবে তার অভিষেক ঘটে। আরবী, মেসিডোনিয়ান এবং তুর্কি ভাষায় গান করেন তিনি। গত রমজানে প্রকাশিত হয়েছে আরবী ভাষায় গাওয়া আধ্যাত্মিক আবহ সম্বলিত তাঁর একক নাশিদ ilahi। ‘

Awakening Records শিল্পীদের সঙ্গে এবং একা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কনসার্টে দেখা যায় তাকে। বিভিন্ন সেবামূলক কাজে ফান্ড সংগ্রহ করার জন্য কনসার্ট করেন তিনি।

আরব আমিরাতের পত্রিকা দ্য ন্যাশনালের একটি সাক্ষাৎকারে মেসুত কুর্তিস তার সঙ্গীত ও শিল্পভাবনার কথা বলেছেন।

কিভাবে একজন ভালো শিল্পী হয়ে উঠলেন এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি শিল্পী হতে হলে প্রথমে আপনার নিজের সম্পর্কে জানতে হবে। শুধু গলা সুন্দর হলেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে স্টেজে উঠে গান গেয়ে ফেলা ব্যাপারটি আসলে এতটা সহজ নয়। আপনার অবশ্যই নিজের চিন্তাভাবনা নিরীক্ষণ করার মতো অন্তর্দৃষ্টি থাকতে হবে। এটা বিশেষ করে নাশিদ লেখার ক্ষেত্রে কাজে দেয়।

ভালো নাশিদের জন্য কথা ভালো হওয়া জরুরি নাকি সুর সেই প্রসঙ্গ তিনি বলেন, ‘নাশিদ সাধারণত কথা দিয়েই বিচার করা হয়। তার মানে এই না যে, সুর ভাবার মতো বিষয় না। সুন্দর বার্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্ত সুর ও ছন্দও আকর্ষণীয় হওয়া চাই।’

মেসুত কুর্তিসের এমন ভক্তও আছে যারা গানে মিউজিক পছন্দ করেন না, তাদের সম্মানে তিনি রেখেছেন তার গানের Vocals Only ভার্সন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার এমন অনেক ভক্ত আছে যারা আমি গানে যে ম্যাসেজ দিতে চাই তা পছন্দ করেন কিন্তু মিউজিকের ব্যবহার তারা মানতে পারেন না। একজন মুসলিম হিসেবে আমি জানি, কোন কোন স্কলারের মতে গানে মিউজিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। আমি সবসময় মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান করি।

ইসলামে শিল্পের স্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, যদি নিয়ত সঠিক থাকে এবং সঠিকভাবে করা হয়, তাহলে শিল্প আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ইসলামের সঙ্গে শিল্পের কোন সংঘর্ষ নেই। কারণ ইসলাম নিজেই একটি শিল্প। আপনি কোরআন ও কোরআনের সুরে তার প্রমাণ দেখতে পাবেন। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই সেরা শিল্পী। তার সৃষ্টিতে সেই শিল্পের কারুকার্যের দেখা মেলে। আমাদের কাজ হচ্ছে তার সৃষ্টিকে আবিষ্কার করা এবং এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হওয়া।

মেসুত কুর্তিসের গানে ইসলামের শিক্ষা আছে, নবীজী মুহাম্মাদের (সা.) প্রতি ভালোবাসা আছে, হতাশার বিপরীতে আশার কথা আছে। আরও আছে মোহনীয় সুর ও ছন্দ। মেসুত কুর্তিসের কণ্ঠে ইসলামী সঙ্গীতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

মুসলিম মেমো​ অবলম্বনে ফিচারটি লিখেছেন ‘আদিল মাহমুদ’

টি.কে ওয়েভ-ইন