সাহিত্যের কথা বলতে গেলে জানতে হবে শিল্প কি? বস্তুজগতে মানুষ যা দেখে তা প্রাকৃতিক। কেউ যদি এর ছবি তোলে তো সেটা আলোকচিত্র। কেউ যদি প্রাকৃতিক কিছুকে নিজের মনের মধ্যে নিয়ে বিমূর্ত করে আপন হৃদয়ের রঙ মিশিয়ে বাইরে এনে প্রকাশ করে তখন সেই মূর্ত বিষয়টি তার নিজস্ব হয়ে যায়। এমন ব্যক্তিগত বিষয় যখন মানুষের কাছে আমাদের বলে অনুভূত হয় তখনই সেটা শিল্প হয়। শিল্পের লক্ষ্য সব সময় শুভ, কোনো সময় অশুভ নয়। শিল্প যারা সৃষ্টি করে তারা শিল্পী। শিল্পীর সৃষ্টিকে বলা হয় শিল্পকলা। সাহিত্য এমন একটি শিল্পকলা।
শিল্পী জাতীয় সংসদের গৃহ নির্মাণ করে, সে স্থপতি। শিল্পী রেখা-রঙে মোনালিসাকে আঁকে, সে চিত্রশিল্পী। শিল্পী ভঙ্গি দিয়ে, অঙ্গ সঞ্চালন করে আঙ্গুলের মুদ্রার মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করে, তার নাম নট-নটী। শিল্পী কণ্ঠের মাধ্যমে তাল-লয়ের ভেতর দিয়ে সুর সৃষ্টি করে , সে সুরকার। আর শব্দ ও পদবিন্যাসের মাধ্যমে মানুষকে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রকাশ করে যে শিল্পী তাকে বলা হয় কথাশিল্পী। সাহিত্য হচ্ছে শব্দ ও পদবিন্যাসের শিল্পকলা। স্তরে স্তরে সাজানো কথার পর কথা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, আলাওল, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, বিহারিলাল, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদ, রোঁমা রোলাঁ, সেক্সপিয়ার, মিল্টন, গোর্কি, মায়াকভস্কি, এমন আরো বহুজনের সাজানো শিল্পময় কথামালাই সাহিত্য। সাহিত্যের সাফল্যের মূলে হচ্ছে কথা।
চিত্রশিল্প, সংগীত, ভাস্কর্য, স্থাপত্য এগুলো শিল্পকলার আরো শাখা। দেখা যায় অনেক সময় সাহিত্য এসব শিল্পকলাকে নিজের মধ্যে অঙ্গিভূত করে নেয়। কোনো উপন্যাসের ভাষা এমনই হয় মন বলে যেনো সেখানে সুরের স্পর্শ আছে।এমনিভাবে অন্যান্য শিল্পকলারও মিশ্রণ ঘটে যায় সাহিত্যে। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার যে সাহিত্যিক মূলত শব্দশিল্পী। তাকে শব্দ সাজিয়েই সাহিত্যের উৎকর্ষ বাড়াতে হয়।
সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্ধারণে আরো একটা শব্দ এসে পড়ে, সেটা হচ্ছে মানবতা। শব্দশিল্পীকে মানুষের মানবীয় প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে কারবার করতে হয়। যেসব গুণাবলী পশুস্তর থেকে মানুষকে অালাদা করেছে সেসবই মনুষ্যত্ব, সদগুণ, মানবতা। মানবতা মানুষকে জীবনমুখী করে, মানুষের শ্রম-ভাষা-চিন্তা এই সদগুণগুলোকে সামনের দিকে পরিচালিত করে, তাকে সংগঠিত করে এবং প্রেমের শক্তি ছড়িয়ে সৃষ্টিতে মাতিয়ে তোলে। মানবতার মাধ্যমেই মানুষ তার সকল আদিম প্রবৃত্তিকে শাসন করতে শিখেছে, জীবনের বিকাশের জন্য যা অপরিহার্য।
পাঁচ হাজার বছর হয় পৃথিবীতে কথাশিল্পীরা ছোট-বড় অনেক বই লিখেছেন। কিন্তু আমরা সবগুলোকে শিল্পকলার স্বীকৃতি দিতে পারি না, আমরা তাদের একই মূল্যে কদর করি না। কোনো বইয়ের লেখার সময়টাতে প্রচণ্ড আবেদন ছিলো, একদিন তা অগণিত হৃদয়কে আন্দোলিত করেছিলো, কিন্তু সেটি আজ আমাদের রস বিচারের মানদণ্ডে টেকে না। বইকে যুগোত্তীর্ণ করতে হলে শিল্পীর সংযম, পরিমিতিবোধ থাকা প্রয়োজন। কথার মাধুর্য, আলোড়ন, বেগ, পরিচ্ছন্নতা এসব যে পরিবর্তনশীল এ ধারণাও থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ গতিশীলতা যে সাহিত্যের মূল বিষয় শিল্পীর বোধে তা ধাকবে। গতিশীলতার জন্যই সাহিত্যের নানা রূপ হয়, বিবিধ ধরনের বিস্তার হয়।
সাহিত্যের উপকরণ সম্পূর্ণভাবে লৌকিক, এটা একটা মত। অন্য একটা মত, সাহিত্য নিজেই নিজের পরিচয়। কখনো নিরপেক্ষতার উপাদানটির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারো মতে মনস্ততত্ত্ব হচ্ছে সাহিত্যের একটি স্থায়ী সূত্র। কারো মতে সাহিত্যের বিষয় বিশ্ব জগতের মানুষ। এমনি আরো অনেক খণ্ড খণ্ড মত রয়েছে। আসলে সাহিত্যের মূল বিষয় মানুষের জীবন। গতিশীল জীবনের গতিশীল প্রতিচ্ছবিকে যদি আমরা সাহিত্য বলি তাহলে জীবনের সমগ্র দিকটাই ওঠে আসে। সুতরাং জীবনের খণ্ড বা অংশ এবং সমগ্রকে নিয়েই সাহিত্য। অর্থাৎ জীবনের অংশ ও সমগ্র হচ্ছে সাহিত্যের দ্বান্দ্বিকতা।(চলবে)———