বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪ -|- ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০-বসন্তকাল -|- ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার ফজিলত ও শর্ত

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৩
বাহাদুর ডেস্ক || ইসলাম ও জীবন
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ১১, ২০২৩, ৫:৪১ অপরাহ্ণ
ইতিকাফ আরবি শব্দ। ‘আকফ’ মূলধাতু থেকে গঠিত। আকফ শব্দের অর্থ হলো অবস্থান করা, স্থির থাকা। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী—‘…আর তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে যৌন মিলন কোরো না, যখন তোমরা মসজিদে ইতিকাফে থাকো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৭)

ইতিকাফের পরিচয় : আভিধানিকভাবে কোনো বস্তুকে বাধ্যতামূলকভাবে ধারণ করা কিংবা কোনো বস্তুর ওপর নিজেকে দৃঢ়ভাবে আটকিয়ে রাখার নাম ইতিকাফ। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, যেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয়—এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। দুনিয়াবি কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা হয়ে সওয়াবের নিয়তে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। সব সময় ইতিকাফ জায়েজ। তবে রমজান মাসে তা উত্তম ও রমজানের শেষ দশকে কদরের উদ্দেশ্যে তা সর্বোত্তম। রাসুল (সা.) প্রতিবছর রমজানে ইতিকাফ করেছেন এবং ইতিকাফ করার জন্য সাহাবাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।

ইতিকাফের ফজিলত : রমজানের শেষ দশকে আল্লাহর অসংখ্য-অগণিত রহমত উম্মতে মুহাম্মদির ওপর অবিরাম ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। আল্লাহর রহমতে জোয়ার আসে। তাই এ দশকের ইতিকাফে বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসুল (সা.) নিজেও এই দশকে ইতিকাফ করেছেন এবং ইতিকাফকারীদের জন্য বহু সওয়াবের সুসংবাদ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি ও দোজখের মধ্যে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করেন।’ (তাবারানি ও হাকেম)

আর প্রত্যেক খন্দক পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের চেয়ে আরো বহুদূর।

আলী বিন হোসাইন (রা.) নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করে, তা দুই হজ ও দুই ওমরাহর সওয়াবের সমান।’ (বায়হাকি)

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইতিকাফকারী সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইতিকাফকারী গুনাহ থেকে বিরত থাকে। তাকে সব নেক কাজের কর্মী বিবেচনা করে বহু সওয়াব দেওয়া হয়।’ (ইবনে মাজাহ)

ইতিকাফের উদ্দেশ্য

ইতিকাফের প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা। ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য শবেকদর তালাশ করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে, অতঃপর ইতিকাফ করেছি মাঝের দশকে, অতঃপর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম, তারপর আমাকে বলা হলো, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ইতিকাফ করতে চায় সে যেন ইতিকাফ করে, অতঃপর লোকেরা তাঁর সঙ্গে ইতিকাফ করল। (মুসলিম, হাদিস : ১১৬৭)

এ ছাড়া ইতিকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াতের সুযোগ হয়। ঐকান্তিকভাবে তাওবা করার সুযোগ লাভ হয়। তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়। সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।

ইতিকাফের শর্ত

ইতিকাফের অনেকগুলো শর্ত রয়েছে।

১. ইতিকাফের জন্য কেউ কেউ রোজার শর্ত করেছেন; কিন্তু বিশুদ্ধ অভিমত হলো রোজা শর্ত নয়। কেননা রাসুল (সা.) থেকে প্রমাণিত আছে যে তিনি কোনো এক বছর শাওয়ালের প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছিলেন, আর এ দশকে  ঈদের দিনও  আছে। আর ঈদের দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ।

২. ইতিকাফের জন্য মুসলমান হওয়া শর্ত। কেননা কাফিরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না।

৩. ইতিকাফকারীকে বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা  নির্বোধ ব্যক্তির কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ শুদ্ধ হতে পারে না।

৪. ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কম বয়সী, যে ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না, তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না।

৫. ইতিকাফের নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো ইতিকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়তে। আর এ দুটোর  মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োজন।

৬. ইতিকাফ অবস্থায় নারীদের হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি। কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম, অবশ্য এস্তেহাজা অবস্থায় ইতিকাফ করা বৈধ। (দেখুন—বুখারি, হাদিস : ২০৩৭)

৭. গোসল ফরজ হয়—এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতে হবে। অপবিত্র লোক মসজিদে অবস্থান করা হারাম। যদিও কোনো কোনো আলেম অজু করার শর্তে মসজিদে অবস্থান বৈধ বলেছেন। আর যদি অপবিত্রতা, যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ফলে হয়, তবে সবার মতে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি স্বপ্নদোষের কারণে হয়, তাহলে কারোর মতে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না। আর যদি হস্তমৈথুনের কারণে হয় তাহলে সঠিক অভিমত অনুসারে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৮. ইতিকাফ মসজিদে হতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, যে মসজিদে জামায়াত হয় সে মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ হবে না। (আবু দাউদ)

এ ব্যাপারে সব আলেম একমত যে ইতিকাফ মসজিদে হতে হবে, তবে জামে মসজিদ হলে উত্তম। কেননা এ অবস্থায় জুমার নামাজের জন্য ইতিকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না।

ইতিকাফের সময় : নফল বা মুস্তাহাব ইতিকাফ সামান্য সময়ের জন্যও হতে পারে। অর্থাৎ যদি কেউ এক মিনিট বা অর্ধ মিনিটের জন্যও ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করে, তাহলে তা ইতিকাফ হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণেই উলামায়ে কেরাম বলেন যে নামাজের জন্য মসজিদে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ইতিকাফের নিয়ত করে নেবে, তাতে নামাজের পাশাপাশি নফল ইতিকাফের সওয়াবের অধিকারী হওয়া যাবে। সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফের সময় হচ্ছে রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের আগ থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত।

ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য ন্যূনতম সময় হলো এক দিন। এক দিনের কম সময়ের জন্য ইতিকাফের মান্নত হয় না। এর অধিক যত দিন মনে চায়, তত দিনের মান্নত করা যায়। কিন্তু যেসব দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ, সেসব দিনে ইতিকাফের মান্নত করা জায়েজ নয়। মান্নতের ইতিকাফের সময় রোজাও রাখতে হয়। কারণ রোজা ব্যতীত মান্নতের ইতিকাফ আদায় হয় না।

যদি শুধু এক দিনের ইতিকাফের মান্নত করে, তাহলে তার সঙ্গে রাত শামিল হবে না। তবে যদি রাত-দিন উভয়ের নিয়ত করে বা একত্রে কয়েক দিনের মান্নত করে, তাহলে রাতও শামিল হবে। দিন বাদ দিয়ে শুধু রাতে ইতিকাফের মান্নত হয় না। (কিভাবে কাটাবেন মাহে রমজান, জাস্টিস মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী)

লেখক : খতিব, বাইতুল মামুর জামে মসজিদ উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর, ঢাকা