আজ বৃহস্পতিবার ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

||
  • প্রকাশিত সময় : অক্টোবর, ১০, ২০২০, ১০:১০ অপরাহ্ণ




মুক্ত আকাশে আর উড়বে না আনাম্মিয়ার ঘুড়ি

মোখলেছুর রহমান, স্টাফ রিপোর্টারঃ    ঘুড়ি বিক্রি করে লাখপতি হওয়া সেই আনাম্মিয়া আর নেই। চলে গেলেন লাখো ভক্তের মন কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সহনাটী ইউনিয়নের সহনাটী গ্রামের কান্দাপাড়া অধিবাসী আবুল কালাম আজাদ অরফে আনাম্মিয়া শনিবার (১০ অক্টোবর ২০২০) নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুতে সহনাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ′′আবুল কালাম আজাদ অরফে ′আনাম্মিয়া’ এ সমাজের একজন দক্ষ কারিগরি ছিলেন। তিনি তার জীবনটাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাজিয়েছিলেন। দরিদ্র থেকে আজ তিনি সচ্ছল জীবনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন এই ঘুড়ি বিক্রি করে। আশেপাশের সকল বাজারগুলোতে এই আনাম্মিয়ার ঘুড়ি বিক্রি হতো। তার এই অকাল মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।” সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন শোক প্রকাশ করে বলেন, ′′আমরা ছোটবেলা থেকেই বাজার থেকে আনাম্মিয়া ভাইয়ের ঘুড়ি কিনে আনতাম। অনেক সময় বাবার পকেট থেকে দশ-পাঁচ টাকা চুরি করেও এই আনাম্মিয়া ভাইয়ের ঘুড়ি কিনে মুক্ত আকাশে উড়াতাম। আনাম্মিয়া ভাইয়ের ঘুড়িতে আলাদা একটা জাদু ছিলো। তার এই মৃত্যুতে সমাজের যে ক্ষতি হয়েছে তা সত্যিই অপূরণীয়। আমরা সবাই তার জন্য দোয়া করি তিনি যেনো বেহেস্তবাসী হন।” জানাজায় ইউপি সদস্য জনাব আব্দুল হামিদ তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন,

′′আমরা আজকে একজন বুদ্ধিজীবীকে হারালাম। কেননা, তিনি যে এতো সুন্দর করে ঘুড়ি বানাতেন তা আর কেউ পারতোনা, সেজন্য আমরা তাকে বুদ্ধিজীবী উপাধিতে ভূষিত করতে পারি।” সহনাটী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মো জালামিন তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ′′আনাম্মিয়া ভাইয়ের মতো এমন ভালো লোক আমার চোখে খুব কম পড়ে। তিনি একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। জীবনে তিনি কাউকে এক টাকা ঠাকাননি। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই সেটা ভাবতেই খুব কষ্ট লাগে।′′ প্রতিবেশিরা জানান, ′′তিনি আজ সকালে কোদাল নিয়ে বাড়ির সামনের ক্ষেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। পরে হঠাৎ করে বুকে ব্যথা অনুভুত হওয়ায় বাড়িতে এসেই দুপুরের দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।”
তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘুড়ি তৈরির সরঞ্জামাদি আনাচে কানাচে পড়ে আছে। রঙ-বেরঙয়ের পলিথিন দিয়ে যে ঘুড়ি তৈরি করতেন সেগুলোও এলোমেলো হয়ে একপাশে পড়ে আছে। তার নিকুঁত হাতের ছোঁয়ায় সেই ঘুড়ি আর তৈরি হবেনা। লাখো ভক্ত আর কোনোদিন আনাম্মিয়ার ঘুড়ির জন্য বাজারে অপেক্ষা করবেনা। বাজারে তার ঘুড়ির আলাদা কদর ছিলো। মৃত্যুর আগে একবার তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেছিলেন,
′′আইজ থাইক্যা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমি তহন ম্যালা চুডু ছিলাম। আমরার ঘরে ভাতের খুব অভাব ছিলো। কিনোদিনই তিন বেলা পেট ভইরা ভাত খাইতে পারি নাই। তহন হঠাৎ একদিন কয়েকটা ঘুড্ডি বানায়া বাজারে চললাম। ঘুড্ডি বেইচ্যা যে টেহা হাইছি হেই টেহা দিয়াই সদাইপাতি কিন্যা মনের সুখে বাড়িতে আয়া পরছি। হেইবালা থাইক্যা আইজ পর্যন্ত আমি ঘুড্ডি বানানিতেই আচি।”
তবে এলাকায় তাকে এই নামে খুব কম লোকেই চেনে। তার ব্যতিক্রমধর্মী একটা নাম রয়েছে। আর সেটা হলো আনাম্মিয়া। ঘুড়ি বিক্রেতা আনাম্মিয়াকে আজ গৌরীপুর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলায় একনামে চেনে। ঘুড়ি বিক্রি করে তিনি সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছিলেন। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে পিতাকে হারান এই ঘুড়ি নির্মাতা। পিতৃপ্রদত্ত বিশ শতাংশ জমির উপর নির্ভর ছিলো তার সংসার। সাংসারিক জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ছেলেমেয়ে দু’জনকেই বিয়ে দিয়েছিলেন এই ঘুড়ি বিক্রি করে। কিনেছিলেন প্রায় ৩০ শতাংশ জমি এবং বসবাস করার জন্য ভাঙা ও পুরাতন জীর্ণ শীর্ণ ঘরের জায়গায় তুলেছিলেন একটি আধা পাকা বাড়ি। একমাত্র ছেলে তেমন লেখাপড়া না করায় বাড়িতেই তাকে একটি দোকান দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসার কাজে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে ঘুড়ি তৈরি করে বদলে দিয়েছিলেন ভাগ্যের চাকা। অথচ একসময় তার জীবন ছিলো খুবই কষ্টের। দিনগুলো যাচ্ছিলো প্রায় অনাহারে অর্ধাহারে। কিন্তু তিনি আজ ঘুড়ি বিক্রি করে হয়েছিলেন লাখপতি।
বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস নামক যে মহামারি চলছে এই ভাইরাসের ছোঁয়া বাংলাদেশে লাগার পর থেকেই আনাম্মিয়ার ঘুড়ি বিক্রির চাহিদা বেড়ে যায়। ধানকাটা শেষ হলে সকলেরই কিছু অবসর সময় থাকে। আর করোনা ভাইরাস আক্রমণের কারণে অনেক অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানুষের অবসর সময় আরো বেড়ে যাওয়াতে তার ঘুড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরই তিনি সবচেয়ে বেশি ঘুড়ি বিক্রি করেছিলেন।

এই ঘুড়ি নির্মাতা শুধু ঘুড়ি তৈরিতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন না। তিনি ঘুড়ি উড়াতেও একজন দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন। অত্র এলাকার যত ঘুড়ি প্রতিযোগিতা হতো সেখানে তিনি ঘুড়ি উড়িয়ে প্রথম স্থান দখল করবেন এটাই ছিলো স্বাভাবিক। গৌরীপুর উপজেলার সাবেক স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ডাঃ ক্যাপ্টেন (অবঃ) মজিবুর রহমান ফকিরের উপস্থিতিতে গৌরীপুর খেলারমাঠে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করে চমকে দিয়েছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)সহ উপস্থিত আমজনতাকে। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন সতেরো ইঞ্চি একটি রঙিন টেলিভিশন।
এই ঘুড়ি নির্মাতা জীবনের তাগিদে ঘুড়ি বানিয়ে জীবনের চাকা বদলে দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

প্রতিদিনই মেঘমুক্ত আকাশে আনাম্মিয়ার তৈরি রং-বেরঙের ছোট বড় যে ঘুড়ি উড়তে দেখা যেতো তা আর দেখা যাবেনা। রাতের অন্ধকারে কিছু সৌখিন মানুষ যখন তাদের ঘুড়িতে লাইটিং ব্যবহার করে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে সৌখিনতার পরিচয় দিবে তখন হয়তো আনাম্মিয়াকে স্মরণ হবে।
আনাম্মিয়া বেঁচে থাকবে আকাশের তারা হয়ে কিংবা কোনো দক্ষ কারীগরের হাতে তৈরি ঘুরিতে ব্যবহৃত রং বেরংয়ের লাইটিং হয়ে।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০