শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

মনুষ্যত্ব পূর্ণ সেই মানুষটি নূতন প্রজন্মের নিকট সৎ সাংবাদিক উপহার দিতে চেয়েছিলেন

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ১৩ মে, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : মে, ১৩, ২০২০, ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

মোঃ রইছ উদ্দিন ঃ
এখনও মাইকে ওয়াজ আসে। এইতো এই চেয়ারেই একদিন বসতেন সুরেশ কৈরী। সুকন্ঠের একজন মানুষ। আমি তখন ছোট্ট, স্টেডিয়ামে মহান বিজয় দিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে আসি। ১৯৯৬সন থেকে সতিশা যুব ও কিশোর সংঘ নিয়মিতভাবে কুচকাওয়াজ, শারীরিক কসরতে অংশ নেয়। এ সংগঠনের সূত্র ধরেই পরিচয় ছিল সুরেশ কৈরীর সঙ্গে।
দক্ষ উপস্থাপন ছিলেন। মাইকে ঘোষণা দিতেন, এখন মাঠে নামবে সতিশা যুব ও কিশোর সংঘ। সেই আওয়াজ আজও আমার কানে ভেসে আসে। তিনি যে চেয়ারে বসে উপস্থাপনা করতেন, এই চেয়ারটিতে আমারও বসার সুযোগ হয়েছিলো। উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের দেয়া দায়িত্ব দীর্ঘদিন যাবত পালন করেছি। এ আসনটিও আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় সংগঠক, সাংবাদিক, সমাজসেবক সেই সুরেশ কৈরীর কথা। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। মনুষ্যত্ব পূর্ণ সেই মানুষটি নূতন প্রজন্মের নিকট সৎ সাংবাদিক উপহার দিতে চেয়েছিলেন। হয়তো এখন তা হয়নি, ভবিষ্যতে কতটুকু হবে তাও ভাবা কঠিন। কেননা যে সুরেশ কৈরী গৌরীপুরের লক্কর-ঝক্কড় মার্কা গাড়ীতে চড়ে আসছিলেন, সেই গাড়ী ২০বছরেও বদল হয়নি। দূর্ভোগে থাকা গৌরীপুরবাসীর কথা আমরা অনেকেই লেখি না আর দু’একজন লেখেন তাও কার্যকারিতা হয়না।
প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি কমল সরকারের নিকট শোনেছিলাম। সুরেশ কৈরীর তোলা ছবি প্রথম পাতা ছাপা হয়েছিল। তিনি সহযোগী সাংবাদিকদের সহযোগিতা করতেন। লেখার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা দিতেন। বর্তমান সভাপতি মোঃ শফিকুল ইসলাম মিন্টু’র নিকট শোনে ছিলাম, দৈনিক ইত্তেফাকে তার প্রথম নিউজ ছাপা হয়ে ছিল শুধু ‘গৌরীপুর’। অর্থাৎ সারাদেশে আরও যেসব স্থানে এ দিবস পালিত হয়েছে সেই ডেস্ক নিউজে শুধুমাত্র গৌরীপুর শব্দটি লেখা ছিল। সুরেশ কৈরী সাহস দিয়েছেন। লেখ, একদিন সব হয়ে যাবে। সেই সাহসেই মিন্টু’র এগিয়ে চলা। আজ অনেক বড় মাপের একজন সাংবাদিক। সুরেশ কৈরী’র মতো ছড়িয়েছেন অনেক সুনাম।
প্রকাশিত সংবাদ সংরক্ষণেও সুরেশ কৈরী ছিলেন একজন দক্ষ কেরানীর মতো। আমার সংবাদপত্রের শিক্ষাগুরু ম. নুরুল ইসলাম এর নিকট দেখেছিলাম তার প্রকাশিত সংবাদের সংগ্রহের একটি রেকর্ড। তিনি গৌরীপুর নিয়ে ভাবতেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মুক্তিযুদ্ধসহ সর্ববিষয়ে লিখতেন। সেই বয়সের এখনও অনেকেই সংবাদপত্রের পাতায় সুরেশ কৈরীকে খোঁজেন। তার মতো কি আমরা কেউ হতে পেরেছি, পাঠককের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হয়েছি! বারবার আমি আমাকে প্রশ্ন করেছি, উত্তরটি এখনও পাইনি!
স্যালুট জানাই সুরেশ কৈরীর দেশের প্রতি ভালোবাসার হৃদয়টাকে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। ইচ্ছা করলেই আজকের মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাইয়ের মতো বড়ো মাপের সাংবাদিক বা দেশের অনেক বড় কর্মকর্তা হতে পারতেন। তিনি তা না করে, ছুটে এলেন গৌরীপুরে। প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রাম, পথ, প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে মানুষের কষ্টের কথা লিখতে শুরু করলেন। সমস্যা, সম্ভাবনা সবই যেন ছিল চোখের সামনে। মুর্হুতেই সংবাদ লেখতে পারতেন। কঠিন সাংবাদিকতা সময় অতিক্রম করে গেছেন সুরেশ কৈরী। সেসময় ইন্টারনেট, ডিজিটাল ক্যামেরা আর আজকের মতো অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা ছিল না। তবে সুরেশ কৈরী কষ্টের মাঝে সংগ্রাম করে বাড়িয়ে ছিলেন গৌরীপুরে সংবাদপত্রের মান, সুনাম।
তিনি শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না, গৌরীপুরবাসীর একজন অভিভাবকও ছিলেন। সুরেশ কৈরী আজ আমাদের মাঝে নেই, সেটা ভাবা কঠিন। তার গড়ে তোলা প্রেসকাবের সামনেই রাস্তাটি পৌরসভা তাঁর নামে নামকরণ করে শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। এ পথে চললেই মনে করিয়ে দেয় তাঁর পান ছিবানো মুখে মিষ্টি হাঁসির মাঝে সুন্দর সুন্দর কথাগুলো। ক্ষমা করো আমাদের আমরা হতে পারেনি, তোমার যোগ্য উত্তরসুরী। কেন, এই ক্ষমা চাইব না, রাস্তাটি আজ সংস্কার হলেও একপাশের নামফলক আজও করা হয়নি।
ক্রীড়াঙ্গনেও বিচরণ ছিল সুরেশ কৈরীর। সাহিত্যেও ছিল দখল। সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল। তাই সাংবাদিকদের ঐক্য, একতা ও সংবাদপত্রে এগিয়ে চলার জন্য জন্ম দিয়েছিলেন গৌরীপুর প্রেসকাব। প্রতিষ্ঠাকালীন এ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রেসকাবের উদ্বোধন নিয়ে দৈনিক জাহানের ১৭ ফেব্রুয়ারি/৮৩ইং সংখ্যায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রেস কাবের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন। এ সময় উপস্থিত ছিরেন দৈনিক জাহানের সম্পাদক হাবিবুর রহমান শেখ (বর্তমানে প্রয়াত), কাজী আব্দুল মোনায়েম (সদ্য প্রয়াত), আব্দুল খালেক (প্রয়াত), সুরেশ কৈরী ও থানা গনসংযোগ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
সাংবাদিকতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করে তিনি দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। জেলার সুনামধন্য জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক জাহানের সাব-এডিটর হিসাবেও কাজ করেন। গৌরীপুর সমাচার নামে তিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মানুষের সেবা ও উন্নয়নের জন্য গড়ে উঠে আদর্শ পরিবার সংস্থা। এ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতো পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রকল্প। এ প্রকল্পের নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদপত্র জগতে সাংবাদিক সুরেশ কৈরী ছিলেন গৌরীপুরের সাংবাদিকদের অগ্রপথিক।
তিনি গৌরীপুরের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উন্নয়নে কাজ করতেন। সকল সাংবাদিকদের ওই আড্ডার জায়গা ছিল গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনের নার্গিস গ্রন্থ বিতান। এছাড়া রাবেয়া বুক হাউজের আমিনুল ইসলাম দুলালও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমি সংবাদপত্রে আসার পর তিনিই ছবি দিয়ে বন্ধুর মৃত্যু বার্ষিকীর সংবাদটি প্রকাশের জন্য প্রতিবছর কাজ করতেন। আমাকে কয়েকবার তিনি ছবি সরবরাহ করে ছিলেন। আজ আমরা অনেকেই ভুলে যাচ্ছি সুরেশ কৈরীকে। তবে ভুলে যায়নি গৌরীপুরে উপকৃত হওয়া লাখো মানুষ। সারের কেলেঙ্কারী নিয়ে একটি ঘটনা প্রসঙ্গে ডৌহাখলার রতন সরকার বলেছিলেন, সুরেশ কৈরী সেদিন সঠিক পথ দেখিয়ে ছিল।
হে সুরেশ কৈরী, ক্ষমা করো মোদের আমরা অবুঝ, না শোনেই হয়তো করেছি অনেক ভুল। মৃত্যুর পরে তোমার মটের টাইলর্স লাগানোর টাকাও গিলে খেতে আমরা কার্পণ্য করেনি। অবশ্য এ টাকা উদ্ধারে আমাকে থানায় একটি অভিযোগ করতে হয়েছিল। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে একজনের টাকা উদ্ধার হলেও অন্যজন আজও দেয়নি। এ দু’জন্যই এক সময় জাদরেল সাংবাদিক ছিলেন। নিজেদের নামটা খুব বড়ো করেই অন্যদের মাঝে প্রকাশ করেন। ধিক তোমাদের!
জুয়া খেলায় নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। রাস্তায় নিরাপদ নেই কেউ! যানবাহনে চলছে নির্যাতন, কৃষক পাচ্ছে না ন্যায্য মূল্য। রাজনীতিতে নীতি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এমন সময় প্রয়োজন ছিল সুরেশ কৈরীর। হয়তো এগুলো কিছুই সমাধান দিতে পারছেন না, তবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের জন্য গৌরীপুরে অভিভাবক হিসাবে থাকতেন নিশ্চিত।
সুরেশ কৈরীকে খুব কাছে থেকে দেখা পৌরসভার সাবেক মেয়র মোঃ শফিকুল ইসলাম হবিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই দিনে। সুরেশ কৈরীর অবদানকে স্মরণ করে দীর্ঘদিন পরেও হলেও তিনি মরেণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর পক্ষে সহধর্মিনী আলো কৈরী এসেছিলেন, স্বামীর অর্জিত সম্মাননা গ্রহণে। আমি বৌদির সঙ্গে একটি ছবি তোলে ছিলাম। বৌদির নিকট দোয়া চেয়েছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য দু’টি মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত পাওয়ার পরেও আমি যেতে পারেনি। আর্শীবাদ করি সৃষ্টার নিকট সুরেশী কৈরী রেখে যাওয়া দু’সন্তান যেন সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে পারে। বৌদির সুস্থ্যতা কামনা করছি। তৎকালিন পৌর চেয়ারম্যান আব্দুল আলী’র নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি, তারও বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, রাস্তার নামকরণে তাঁর অবদানের জন্যে। বর্তমান পৌর মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলামের নিকট দাবি জানাই, সাংবাদিক সুরেশ কৈরীর সম্মানার্থে এ সড়কটির এক পাশের নামফলক নেই, সেটি করার জন্য এবং দু’পাশে আধুনিক স্টাইলযুক্ত নামকরণ ফলক দেয়ার জন্য।
তবে সুরেশ কৈরীর নামে আমরা চালু করেছি ‘সাংবাদিক সুরেশ কৈরী সম্মাননা’। এ সম্মাননা এবারও অব্যাহত থাকবে। করোনা ভাইরাসের কারণে এই মুর্হূতে এ পদক দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে আমরা ২০জনকে এ সম্মাননায় ভূষিত করেছি। অবশ্য এ কাজ করতে গিয়েও খেতে হয়েছে… দু’টো কারণ দর্শানোর নোটিশ, ছি: ধিক! পত্রদ্বয় হয়তো আগামী দিনে-দালিলিক প্রমাণ হিসাবে আমাদের চরিত্র বা আচারণ নিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম গবেষণায় কাজে আসছে পারে!!
যে মানুষটি মানুষের কথা ভাবতেন, যে নিজের খেয়ে অন্যের কাজ করে দিতেন, সেই মানুষটি ছিল সুরেশ কৈরী। প্রভু তাঁকে নিশ্চয় স্বর্গবাসী করবেন। প্রার্থনাও করি তিনি যেন স্বর্গবাসী হন। তবে আমাদেরই মনে হয় খুব প্রয়োজন ছিল একজন সুরেশ কৈরীর।
লেখক ঃ মোঃ রইছ উদ্দিন, উপজেলা প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর, গৌরীপুর, ০১৭১৮০৬৯২১০