সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ৭ জুন ৬০ গ্রেডের প্রতি টন রডের দাম ছিল ৭৩ থেকে ৭৪ হাজার টাকা। এ বছরের ৭ জুন সমপরিমাণ রডের দাম ছিল ৮৭ হাজার থেকে ৯১ হাজার ৫০০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ১৯ থেকে প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে রডের দাম।
বাজেটে প্রতি টন রডের উৎপাদন পর্যায়ে কর ৫০০ থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে রডের দাম কিছুটা কমার সম্ভাবনা থাকলেও সিমেন্ট, পাথর, বালু, ইটসহ প্রায় সব ধরনের সামগ্রীর দাম বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্মাণকাজ বন্ধের পথে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, নির্মাণসামগ্রীর দামের পাগলা ঘোড়ায় কাজের গতি কমেছে। ঠিকাদাররা বলছেন, লোকসানের ভয়ে অনেকে কাজ বন্ধ রেখেছেন।
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হয়ে রংপুর পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (সাসেক-২) প্রকল্পের আওতায়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীনে চলমান এ প্রকল্পের একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী গত সপ্তাহে আলাপচারিতায় সমকালকে বলেন, ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করানো যাচ্ছে না।
প্রকল্পের একটি প্যাকেজে ঠিকাদার শর্তানুযায়ী ৬০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলে যা জব্দ করতে পারবে সওজ। কাজ শুরুর তাগাদা দেওয়া হলে ঠিকাদার জানিয়ে দেন, কাজ করলে ৮০ কোটি টাকা লোকসান হবে। তার চেয়ে ৬০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি জব্দ করুক। তাতে লোকসান কম হবে। সওজসহ সরকারের কয়েকটি সরকারি সংস্থার প্রকল্পে কাজ করছে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হায়দার রতন সমকালকে বলেছেন, একজন ঠিকাদার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে কাজ নেন। কিন্তু গত ছয় মাসে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। কীভাবে কাজ করবেন?
সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) সবুজ উদ্দিন খান বলেছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। কিন্তু ঠিকাদারকে চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। চুক্তিতে প্রাইজ অ্যাডজাস্টমেন্টের (মূল্য সমন্বয়) সুযোগ নেই। নির্মাণসামগ্রীর দাম যতই বাড়ূক, চুক্তিমূল্যে কাজ করতে হবে।
তবে সওজ কর্মকর্তারাও অনানুষ্ঠানিক আলাপে মানছেন, দাম বৃদ্ধির কারণে কাজের গতি কমে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গেছে। সওজ ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার কামাল ফিরোজ সমকালকে বলেছেন, ২০১৯ সালের রেট শিডিউল (পূর্তকাজের মূল্যহার) অনুযায়ী নির্মাণসামগ্রীর দাম ধরা হচ্ছে। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। ২০১৯ সালে এক টন রডের দাম ছিল ৫৫ হাজার টাকা। এখন ৯২ হাজার টাকা। তখন এক বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৩৭৫ থেকে ৪০৫ টাকা। এখন ৪৬০ টাকা।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান জানিয়েছেন, রেট শিডিউল হালনাগাদের কাজ চলছে। আগামী মাসের মধ্যে তা হয়ে যাবে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা মেনেই রেট শিডিউল সংশোধন করা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রেট শিডিউল হালনাগাদ করছে। রেলেও কাজের গতি কমেছে দামের কারণে। রেলের একজন যুগ্ম মহাপরিচালক বলেছেন, কিছু প্রকল্প একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। সওজ কর্মকর্তারা বলেছেন, রেট শিডিউল নির্ধারণ করা হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী। বিবিএস খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ম্ফীতির জরিপ গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেছে। তবে জরিপে দেওয়া তথ্য নভেম্বরে সংগ্রহ করা। সওজের একজন প্রকৌশলী সমকালকে বলেছেন, মূল্যস্ম্ফীতি কম দেখাতে বিবিএস দাম কম দেখায়। যদিও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান একাধিকবার দাবি করেছেন, মূল্যস্ম্ফীতি কম দেখানোর চেষ্টা নেই।
সঠিকভাবেই তা গণনা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী সমকালকে বলেছেন, তাঁরা চেষ্টা করছেন হালনাগাদ তথ্য পেতে। নইলে সর্বশেষ যে তথ্য রয়েছে, তার ভিত্তিতে নতুন রেট শিডিউল হবে।
সম্মিলিত ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুশফিকুর রহমান হান্নানের প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরে ঠিকাদারি করে। তিনি বলেছেন, সরকারি ভবন নির্মাণ ঠিকাদারদের একই দশা। কাজ বন্ধ হওয়ার পথে। নভেম্বরের দাম ধরে রেট শিডিউল নির্ধারণ যৌক্তিক হবে না। গণপূর্ত রেট শিডিউল হালনাগাদ করা হচ্ছে না। ঠিকাদাররা কি লোকসান দিয়ে কাজ করবেন?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে। তবে উৎপাদনকারীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও যুদ্ধের কারণে জাহাজ ভাড়া বাড়ার কারণে রড ও সিমেন্টের মূল্য বাড়ছে। সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিঙ্কারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৪২ ডলার। জাহাজ ভাড়ার কারণে এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৫ ডলার। ডলারের বিপরীতে টাকা মান কমে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে দাম আরও বেড়েছে।
সিমেন্ট ডিলার আবু হোসেন সমকালকে বলেছেন, গত বছর প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা। ফলে এক টন ক্লিঙ্কারের দাম পড়ত ৩ হাজার ৫২৮ টাকা। টনপ্রতি ১২ ডলার দাম বাড়লেও টাকার মান কমে যাওয়ায় সেই ক্লিঙ্কারের দাম এখন পাঁচ হাজার টাকার বেশি পড়ছে।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে ভালো মানের এক ব্যাগ সিমেন্টের দাম ছিল ৪০৫ টাকা। তা এখন ৪৮০ টাকা। দুই বছরে পাথরের দাম প্রতি ঘনফুটে ১৬০ থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা হয়েছে। বালুর দাম আট টাকা ঘনফুট থেকে ৩০ টাকা হয়েছে। সিলেট বালুর দাম ২৫ থেকে বেড়ে ৫৫ টাকা হয়েছে।
সরকারি সব সংস্থার জন্য অভিন্ন রেট শিডিউল তৈরি করার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। গত মাসে অংশীজনের সঙ্গে সঙ্গে সওজের সভাসূত্রে জানা গেছে, তিন বছরের চেষ্টায় অভিন্ন রেট শিডিউল তৈরির বিষয়ে সুরাহা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অপর সভায় সিদ্ধান্ত হয়, একেক সংস্থার কাজের ধরন একেক রকম; অভিন্ন রেট শিডিউল তৈরি করা সম্ভব নয়।
সাসেক-২ প্রকল্পে এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতুর ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির চুক্তি হয়েছে। ছয় মাস কাজই শুরু করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সড়ক যোগাযোগ খাতের বড় ঠিকাদার এমএম বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন বলেছেন, অনেকের একই অবস্থা। কাজ করতে পারছে না।
সরকারের পক্ষ থেকে দেশীয় ঠিকাদারকে বেশি কাজ দিতে সংস্থাগুলোকে বলা হচ্ছে। কিন্তু ঠিকাদাররা বলছেন, মুখে বললেও অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। আলী হায়দার চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলোতে সংশ্নিষ্ট দেশের ঠিকাদারদের নির্মাণসামগ্রী আমদানিতে কর দিতে হয় না। কিন্তু দেশীয় ঠিকাদারদের পাথর ও বিটুমিন আমদানিতে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হচ্ছে। আবার কাজের মূল্যের বিপরীতে ১৩ শতাংশ ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হচ্ছে।
ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, রেট শিডিউল হালনাগাদ করা না হলে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। এতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমলে নিয়ে ভ্যাট-ট্যাক্স মাফ ও মূল্য সমন্বয় করা প্রয়োজন।
রড-সিমেন্টের মতো ভোগাচ্ছে পাথরও। সওজের প্রকল্প বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ বিষয়ে গত মাসে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়েছে, ভারত ও ভুটান থেকে আসে পাথর। ভারত সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে পাথর সংকট তৈরি হয়েছে। বিষয়টি সমাধানে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। তবে মনির হোসেন পাঠান বলেছেন, পাথর সংকটের সমাধান হয়েছে।