বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪ -|- ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০-বসন্তকাল -|- ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

ধর্মের আত্মা মানব প্রেম

প্রকাশিত হয়েছে- শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : জানুয়ারি, ১১, ২০২০, ১:৫৩ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ জহিরুল আলম

সৃষ্টির মূলে রয়েছে প্রেম। প্রেম ছাড়া কোনো কিছুরই উদ্ভব হতো না। এটি এক মহাশক্তি; এমন এক শাশ্বত মানবিক শক্তি যা মানুষ সহজাতভাবেই অর্জন করেছে। প্রেমকে আমরা শুধু বাস্তব সংসারে নর-নারীতে পাই না, পাই মানবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সঙ্গে।

মানবাত্মা যে উৎসের দিকে ছুটছে তাই ঐশীপ্রেম। মানবের প্রেম তার সৃষ্টির অংশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন- আমি যখন তার আকৃতি সুবিন্যস্ত করব এবং তাতে আমার রুহ সঞ্চার করব তখন তার প্রতি সিজদা করও (সূরা হিজর : আয়াত ২৯)।

সৃষ্টিকর্তা বলেই দিলেন তিনি প্রথমে মানবদেহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার মাঝে নিজের রুহ ফুঁকে দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করেছেন। আল্লাহর প্রেম থেকেই পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টি। মানুষের হৃদয়ে প্রেমই বিদ্যমান। স্রষ্টার সৌন্দর্যই প্রেম। স্রষ্টাই হলেন পরম সৌন্দর্যময় সত্তা, প্রকৃতির সব সৌন্দর্য তার আংশিক প্রকাশ।

জালালুদ্দিন রুমী (র.)-এর মতে ‘প্রেমই পরম সৌন্দর্য এবং পরম সৌন্দর্যই প্রেম’। প্রেমের মাধ্যমেই মানবাত্মা পরিবর্তিত হয়ে পরমাত্মার বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্টমণ্ডিত হয়ে তার রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। মানুষ যখন খোদা প্রেমের গুণে গুণান্বিত হয় তখন সে মহাশূন্য ও ঊর্ধ্বলোকে পাড়ি দিতে পারে এবং পরম সত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে। প্রেমের আকর্ষণের ফলে জীবন স্রষ্টার সৌন্দর্যের দিকে অগ্রসর হয়।

সৃষ্টির প্রেম স্রষ্টার সঙ্গেই, সৃষ্টির সম্পর্ক থাকবে স্রষ্টার সঙ্গে। আর যে পদ্ধতিতে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাই ধর্ম। ধর্ম বাংলা শব্দ, আরবিতে যাকে দ্বীন বলা হয়। যার মানে জীবনযাত্রার প্রণালি, আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। বিবেকবান মানুষ তা গ্রহণ করলে মুক্তির পথ মেলে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে- অর্থাৎ ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই এটাই সরল ধর্ম।’ (সূরা আর রুম : আয়াত ৩০)।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- অর্থাৎ ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই, সোজা পথ তো ভ্রান্ত পথ থেকে আলাদা।’ (সূরা আল বাকারাহ : আয়াত ২৫৬)। এখানে আল্লাহতায়ালা মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন যে, আল্লাহর ধর্ম সহজ এবং স্পষ্ট। মানুষের জন্য আল্লাহর ধর্ম প্রকৃতির ধর্মের মতো।

পৃথিবীর সব ধর্মে সৎ কাজ, সদাচারের কথা বলা হয়েছে। সবার মৌলিক বিষয়ে মিল রয়েছে। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার নবী-রাসূল এসেছেন। তারা সবাই মানুষের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার প্রেম সৃষ্টি করে প্রভুর সঙ্গে যোগাযোগের পদ্ধতিই শিক্ষা দিয়েছেন।

দয়াল রাসূল (সা.) জন্ম নিলে ইসলাম ধর্ম পূর্ণতা পেয়েছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে- অর্থৎ ‘আজ থেকে আমি তোমাদের জন্য ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা আল মায়িদাহ : আয়াত ৩)।

প্রেমের ধর্ম ইসলাম। জ্ঞানের মাধ্যমে স্রষ্টার গুণাবলি সম্পর্কে গেলেও স্রষ্টাকে বোঝা যায় না। প্রেমের মাধ্যমে মানুষ মানবীয় গুণাবলির স্তর অতিক্রম করে মহাসত্য অর্জন করতে পারে। দয়াল রাসূল (সা.) ঐশী প্রেমের প্রবাহের মাধ্যমেই মরুর বুকে প্রাণের সঞ্চার করেন। মোহাম্মদী ইসলাম সেই প্রেমের ধর্ম যা পৃথিবীর সব জাতিকে এক পতাকার নিচে, এক সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছে।

এখানে প্রাধান্য পায় কেবল ভালোবাসা, ক্ষমা, মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানির কোনো স্থান নেই। দয়াল রাসূল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম এমন এক চরিত্র যার সৌন্দর্য ও বিকাশই হচ্ছে প্রেম। বর্তমান পৃথিবীতে ওলি-আল্লাহ মুক্তিকামী মানুষকে সেই প্রেমই শিক্ষা দিচ্ছেন, যাতে মানুষ তার ব্যক্তিত্বে স্রষ্টার গুণাবলিকে ধারণ করতে পারে। প্রেমই হল ধর্মের আত্মা।

ইসলামের অন্যতম বিষয় ‘ইমান’। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, এমন তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য আছে, কারও এ তিনটি গুণ অর্জিত হলে সে ইমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে- ১. আল্লাহ্ ও হজরত রাসূল (সা.)-এর প্রতি সবচেয়ে বেশি মহব্বত থাকা; ২. কাউকে ভালোবাসলে তা কেবল আল্লাহর উদ্দেশে হওয়া; ৩. কুফর থেকে উদ্ধারের পর আবার কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে পড়ার মতো কষ্টদায়ক ও অপ্রিয় মনে করা। (বোখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

হজরত রাসূল (সা.)-এর প্রতি সবচেয়ে বেশি মহব্বত থাকা হল ইমানের মূল। হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি- কোনো ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত সে তার পিতা-মাতা, ছেলেমেয়ে এবং জগতের সব লোকের চেয়ে বেশি মহব্বত ও ভালোবাসা আমার সঙ্গে না রাখবে। ইমান অর্জনকারীকে মুমিন বলা হয়। সুফি সাধকরা বলেন, ‘দয়াল রাসূল (সা.) কে ভালোবাসার নামই ইমান’।

দয়াল রাসূল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম মানেই প্রেমের ধর্ম। ওলি-আল্লাহ্ দরবারে প্রেমের প্রবাহই বিরাজমান থাকে। সে প্রবাহে হৃদয়ের বন্ধ দ্বার খুলে যায়, চরিত্রের কলঙ্ক দূর হয়, হৃদয় প্রভুর আলোয় আলোকিত হয়। সার্থক হয় মানব জনম। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আজ প্রেমের প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি।

লেখক : প্রাবন্ধিক