শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

দুর্নীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু এক যুদ্ধা : বদলে দেয়ার অঙ্গিকারে ছুটছেন এক নারী শিক্ষা অফিসার!

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ১১ মার্চ, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : মার্চ, ১১, ২০২০, ৭:১৭ অপরাহ্ণ

প্রধান প্রতিবেদক :
বীরঙ্গনা সখিনার স্মৃতিময় এলাকা ময়মনসিংহের গৌরীপুর। তিনি স্বামীকে মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে ছিলেন। আর তারই এলাকায় শিক্ষার পরিবেশ গড়তে আর দুর্নীতিগ্রস্থ অফিস-প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন আর অফিস ঘোষণা করতে কলম হাতে লড়াই করে যাচ্ছেন যোগদানকৃত উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনিকা পারভীন।

দুর্নীতি আর অনিয়মে নিমজ্জিত ছিলো ‘উপজেলা শিক্ষা অফিস’। ‘ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র’, শিশুদের নাস্তার টাকাও লুট, দপ্তরী কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে গণক্ষোভ-মানববন্ধন, ফাইলের প্রত্যেক স্বাক্ষরে উৎকোচ, প্রায় কোটি টাকার ভুয়া বিল-ভাউচারে আগাম বিল উত্তোলন, বদলি বাণিজ্য, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির গোডাউনে পরিণত হওয়ার কারণে ২০১৮-১৯ সংবাদপত্রে একাধিবার আলোচিত শিরোনাম ছিলো এ দপ্তর। ইচ্ছা থাকলে একটি দপ্তর একজন কর্মকর্তা বদলে দিতে পারেন তারই দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ‘উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনিকা পারভীন।’

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মাত্র ১০০ কর্মদিবসে ‘বদলে দেয়ার অঙ্গিকারে’ বদলের ঘন্টা বাজালেন মনিকা পারভীন। অথচ এ দপ্তরের কয়েকজন পুরুষ অফিসারকেও নাজেহাল বা রাতের আধাঁরে বিদায় নিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী তিনি। দুর্নীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু একযোদ্ধার নাম ছড়িয়ে গেছে উপজেলার প্রতিটি অঞ্চলে; তিনি হলেন মনিকা পারভীন।

এদিকে কুচক্রী মহল এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শুরু করেন ষড়যন্ত্র! নিয়োগ-বদলী বাণিজ্যের চক্রটি প্রথম দফা হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে বেছে নেয়। সেখানে শিক্ষা অফিসারের মুখাবয় সংযোগ করে একের পর এর জোড়াতালির অশ্লীল মন্তব্য, ছবি ও কল্পকাহিনী ছড়িয়ে তাকে সরিয়ে দিতে চক্রটি মরিয়া হয়ে উঠেন। সেই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা ও ৩জনকে গ্রেফতার করে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গৌরীপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মমতাজ বেগম। তিনি আরো বলেন, এই নারী কর্মকর্তা- দেশের লাখো নারীর ‘আইডল’; কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখা নারীরও ভূমিকা-তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ছড়িয়ে দিলেই ছেড়ে যাওয়া নয় বরং ওদের দাঁতভাঙা জবাবই একমাত্র প্রতিকার।

অপরদিকে জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া বদলীতে অনিয়ম আর দুর্নীতির গলাটিপে ধরেছেন এ কর্মকর্তা। স্লিপের টাকা আত্মাসাত, প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের টাকায় নয়-ছয় প্রতিরোধে ও সংস্কারের টাকা শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতেও মাঠে নেমেছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে একটি প্রবাদবাক্যও চালু হয়েছে ‘এইলা হেইলা না’ অর্থাৎ স্কুলফাঁকি-কাজফাঁকিবাজদের জন্য আদরে অফিসার না। এদের বিরুদ্ধে ‘কর্মঘন্টা’ এর হিসাব নিচ্ছেন। সেই ঘন্টাধ্বনিতে অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বদলে গেছে চায়ের স্টলে এক শ্রেণির শিক্ষকদের আড্ডাবাজিও। পাল্টে গেছে উপজেলা শিক্ষা অফিসের চালচিত্রও। শিক্ষা অফিসে একাধিবার অনিয়ম-দুর্নীতির হোতাখ্যাত শিক্ষকরা রয়েছে চরম বেকায়দায়। এ চক্রের একাধিক শিক্ষকের কন্ঠে শোনা গেলো নতুন বাণীও ‘ভালো কর্মকর্তা-বেশি দিন গৌরীপুরে ঠিকে (থাকে) না’!

এদিকে বদলে যাওয়া দৃশ্যপট শিক্ষকদের বেতন এবার নির্ধারিত তারিখে, উল্টাপাল্টা বিলের বিভ্রান্তিমুক্ত, বিনাখরচায় স্ব-স্ব বিদ্যালয়ে বিলিং লিস্টে শিক্ষকদের তালিকাভূক্তকরণসহ অফিসেও স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা পদ্ধতি চালু করেছেন এ কর্মকর্তা। লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরাও। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১৭৭টি বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্ণার, শতভাগ বিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজিতে শুদ্ধ উচ্চারণ, শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়নে মনিটরিং কার্যক্রমসহ ২২টি কর্মযজ্ঞে বদলে যাচ্ছে গৌরীপুরের শিক্ষাব্যবস্থাও। এসব কর্মযজ্ঞের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ এম.পি, উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খান ও ১৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি নিয়েও তিনি পৃথক বৈঠক করেন। ছুটছেন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ১৯৯৬সালে তিনি সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসাবে শেরপুর সদরে যোগ দেন। এরপরে তিনি নালীতাবাড়িতে দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পালন করে। ২০১৭সালে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। ২০১৯সালের ৪ অক্টোবর তারিখে উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসাবে গৌরীপুরে আসেন।

তিনি ১৯৮৪সালে নকলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮৬সালে শেরপুর মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি ও ৮৯সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অনার্স, ৯০সালে মাস্টার্স করেন। দাম্পত্য জীবন শুরু করেন মোঃ হাভেজ আহাম্মেদের সঙ্গে। তিনি বগুড়ায় ইসলামিক ফাউ-েশনের বিভাগীয় পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। একমাত্র কন্যা মুবাশ্বিরা মালিয়াত ময়মনসিংহ ক্যান্টেনমেন্ট পাবলিক স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

টি.কে ওয়েভ-ইন