প্রধান প্রতিবেদক :
পাইস্কা বিল। পথচারীরা কয়েকদিন যাবত দেখছেন এক বৃদ্ধ খড়ের ওপর শোয়ে আছে। রাস্তা থেকে প্রায় অর্ধকিলোমিটার দূরে।
সেখানে পড়ে থাকা মানুষটিই হলো ছাবেদ আলী। বয়স ৬০ছুঁইছুঁই করছে। মানসিক ভারসাম্যহীন। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় শীতের তীব্রতা অন্যদিকে খাদ্যহীনতা শরীরের যন্ত্রাংশ হলো অচল হয়ে পড়েছে।
শনিবার (৯ জানুয়ারি/২০২১) সেই বিলে কৃষক বোরো ধান রোপনের জন্য ক্ষেত তৈরি করতে গিয়ে দেখতে পান অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। অনেকটা মৃত ভেবেই খবরটা দেয়া হয় গৌরীপুর থানায়। গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ বোরহান উদ্দিন সেই খবরে দ্রুত ঘটনাস্থলে পাঠান আরেক মানবিক পুলিশ অফিসার (এসআই) মাইনুল রেজাকে।
এস আই মাইনুল রেজা জানান, বৃদ্ধকে মাথায় পানি ঢালেন ও চোখে পানির ঝাপটা দেন। জুসটুস খাওয়ার পর একটি শব্দ বলেন ‘মাওহা’। এটি এ উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম। হারানো জিডিতেও নিখোঁজের তালিকায় তার কোন তথ্য নেই। এরপর সেই ইউনিয়নে তল্লাশী ও নিখোঁজের তথ্য নিয়ে খোঁজে বের করা হয় এ বৃদ্ধর পরিবারকে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরিবারের নিকট পৌঁছে দেই। চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগতভাবে সামান্য আর্থিক সহযোগিতাও করেছি।
১৪ দিন আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন ছাবেদ আলী। অনেক খোঁজ করেও তার সন্ধান পাননি। তাই ছাবেদ আলীকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বজনরা। কিন্ত ছেলে সায়েমের বিশ্বাস ছিল তার বাবা বেঁেচ আছে। একদিন বাড়ি ফিরবে। সেই আশায় পথ চেয়ে থাকতেন তিনি।
অবশেষে সায়েমের বিশ্বাস সত্যিই হলো। বাড়ি ফিরল ছাবেদ আলী। হারানো বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল সায়েম। মুহূর্তেই বাড়ির শোকার্ত পরিবেশ রুপ নিল আনন্দ উৎসবে। খবর পেয়ে স্বজনরাও বাড়িতে ভীড় করল বাবা- ছেলের মিলনমেলা উপভোগ করতে।
তবে যাদের কারণে বাবা- ছেলের এই মিলনমেলার আয়োজন সম্ভব হয়েছে তিনি হলেন ময়মনসিংহের থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাইনুল রেজা। শনিবার দুপুরে এই পুলিশ কর্মকর্তার উদ্যোগে বাড়ি ফিরে মানসিক ভারসাম্যহীন ছাবেদ আলী। এ সময় সঙ্গে ছিলেন গৌরীপুর থানার এএসআই মোঃ মোস্তাক।
জানা গেছে গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের মৃত জাবেদ আলীর ছেলে ছাবেদ আলী। তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। গত বছরের ২৭ নভেম্বর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন ছাবেদ। এরপর পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজ করেও তার সন্ধান বের করতে পারেনি। তাই ছাবেদ বাড়ি ফিরবে এমন আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা।
স্থানীয়রা জানান গত কয়েকদিন ধরেই সিধলা ইউনিয়নের পাইশকা গ্রামে ঘুরাফেরা করছিল বৃদ্ধ লোকটি। গ্রামের মানুষও অসুস্থ পাগল ভেবে তাকে খাবার খেতে দিত। শনিবার সকালে গ্রামবাসী একটি খোলা মাঠে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বৃদ্ধকে। মৃত ভেবে খবর দেয়া হয় পুলিশকে। পরে এসআই মাইনুল রেজা ঘটনাস্থলে এসে বৃদ্ধের চোখে-মুখে পানি ছিটালে জ্ঞান ফিরে আসে। পরে বৃদ্ধ তার পরিচয় জানালে পুলিশ তার পরিবারকে খুঁজে বের করে।
ছাবেদ আলীর ছেলে মো. সায়েম বলেন পরিবারের সবাই বাবাকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলেও আমার বিশ^াস ছিল বাবা বেঁেচ আছে, সে একদিন বাড়ি ফিরবে। আজকে পুলিশ ভাইয়াদের মানবিকতায় আমি বাবাকে ফিরে পেয়েছি। আমি এতই আনন্দিত যে পুলিশকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচিছনা।
তাই ধন্যবাদ দিয়ে তাদের ছোট করতে চাইছিনা। তার ভাতিজা সাকিল জানান, ছাবেদ আলীর বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ বোরহান উদ্দিন জানান, বর্তমান পুলিশ মানবিক ও জনবান্ধব। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মাইনুল রেজা। পেশাগত দায়িত্বের বাহিরে মানবিক কাজ করেছে।
মাইনুল রেজা ২০১৮সালে ৩৬তম এসআই ক্যাডেট ব্যাচে পুলিশে যোগদান করেন। পিএসআই থাকা অবস্থায় মুক্তাগাছা থানায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান করেন ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ানো মাইনুল রেজা এক ধরণের নেশা। গৌরীপুর থানায় আসেন ২০২০সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। একদিন পর বিশ^ ভালোবাসা দিবসের জন্য মধ্যরাতে ছুটে যান রেলওয়ে স্টেশনে ভবঘুরেদের মাঝে। তাদেরকে সেই দিন উন্নতমানের খাদ্য সরবরাহ করেন। রামগোপালপুর ইউনিয়নের শিবপুরে পড়ে থাকা অচেতন বৃদ্ধকে উদ্ধার ও তার চিকিৎসার এবং পরিবারকে খোঁজে বের করেন এই মানবিক পুলিশ। এছাড়াও করোনাকালীন দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি।
তিনি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার বেলগাছা গ্রামের আব্দুল খালেক ও আমেনা বেগম দম্পতির পুত্র। চার সন্তানের মাঝে তিনি সবার ছোট। ২০০৭সালে গুটাইল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি, ২০০৯সালে এডভান্স রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ ময়মনসিংহ থেকে এইচএসসি ও ২০১৪সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স করেন।
টি.কে ওয়েভ-ইন