শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

গৌরীপুরে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তান সেজে ভাতা আত্মসাৎ, ব্যাংক থেকেও নিয়ে গেছে ৫লাখ টাকা ঋণ!

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ২৪ মে, ২০২৩
তাসাদদুল করিম || ওয়েব ইনচার্জ, দৈনিক বাহাদুর
  • প্রকাশিত সময় : মে, ২৪, ২০২৩, ৯:৪৬ অপরাহ্ণ

ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসেম উদ্দিন আকন্দের ভুয়া সন্তান সেজে মোছা. শিরিনা আক্তার নামে এক নারী সরকারি ভাতা আত্মাসাৎ ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেড গৌরীপুর শাখা থেকেও ৫লাখ টাকার ঋণ নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন মোছা. শিরিনা আক্তার। তিনি জানান, তার মা মোছা. হালিমা খাতুনের সঙ্গে মো. শাহজাহান আকন্দের বিয়ে হয়। এ পরিবারের ৫সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। তার মায়ের প্রথম বিয়ে হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসেম উদ্দিন আকন্দের সঙ্গে। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছোট ভাই শাহজাহান আকন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়। তবে তার ভোটার আইডি, নাগরিকত্ব, ব্যাংকের হিসাবসহ সবস্থানে তার বাবার নাম পরিবর্তন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসেম উদ্দিন আকন্দ লেখা হয়। এটা পরিবারের সিদ্ধান্তক্রমেই করা হয়েছি।

এ ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে মোছা. শিরিনা আক্তারের ভোটার আইডিতে তার মায়ের নাম মোছা. হালিমা খাতুন ও পিতার নাম মৃত হাসেম উদ্দিন আকন্দ লেখা হয়েছে। ২০২০সনে ২নং গৌরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন প্রদত্ত ওয়ারিশান সনদপত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসিম উদ্দিন আকন্দের একমাত্র সন্তান হিসাবে মোছা. শিরিনা আক্তারকে ওয়ারিশান দেখিয়ে সনদপত্র প্রদান করা হয়। নাগরিকত্ব সনদপত্রেও অনুরূপ নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান মো. হযরত আলীর দেয়া নাগরিকত্ব সনদপত্রেও অভিন্ন। এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান মো. হযরত আলী জানান, পূর্বের ওয়ারিশান সনদপত্র বিষয়টি আমার জানা নেই। যেহেতু ভোটার আইডিতে তার পিতার নাম হাসেম উদ্দিন আকন্দ লেখা আছে, সে অনুযায়ী নাগরিকত্ব সনদপত্র প্রদান করা হয়েছে।

অপরদিকে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে সেনাবাহিনীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসিম উদ্দিন আকন্দ (মুক্তিযোদ্ধার সেনা গেজেট ১৬৩৫) মারা যান ১৯৮৪সনের ১০ মে। ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের ইয়াকুব আলী, নুর হোসেন, আশ্রব আলী জানান, হাসিম উদ্দিন আকন্দ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। সে বছরের ১৭ অক্টোবর মোছা. হালিমা খাতুন বিয়ের করেন তার মৃত স্বামীর ছোট ভাই শাহজাহান আকন্দকে। তার প্রথম সন্তান মোছা. শাহানা আক্তার। দ্বিতীয় সন্তান মো. হুমায়ুন আকন্দ। তৃতীয় সন্তান মোছা. শিরিনা আক্তার, চর্তুথ সন্তান মোছা. সুপা আক্তার ও পঞ্চম সন্তান মোছা. সোমা আক্তার। তার মধ্যে হুমায়ুন আকন্দের ৬১১৮১৮০০০০৯৫নং জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ৯১সনের ১জুন। তবে তার ছোট বোন হলেও মোছা. শিরিনা আক্তারের জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯৮৪সনের ৫জুলাই। আগের দু’সন্তানের শাহজাহান আকন্দের হলেও শিরিনা আক্তারকে নিয়ে চালানো হয় ভিন্ন প্রচারণা। বলা হয়, আবুল হাসিম উদ্দিন আকন্দ মৃত্যুর সময় সে মায়ের গর্ভে ছিলো। এ প্রসঙ্গে মোছা. হালিমা খাতুন বলেন, আপনারও মা আছে, যা হয়ে গেছে তা চেপে যান। এসব নিয়ে ঘাটাঘানি না করতেও, এ প্রতিনিধিকে অনুরোধ জানান।

তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন মোছা. শিরিনা আক্তার। তিনি বলেন, ভোটার আইডি, জন্মনিবন্ধন, ওয়ারিশান সনদপত্র, নাগরিকত্ব সব কাগজ দেখেন, এসব কাগজপত্র কী ভুয়া! হিসাব রক্ষণ অফিসে এমআইএস করা হয়েছে, প্রায় ৩বছর যাবত ভাতা উত্তোলন করছি, কেউ তো কখনও কিছু বলতে পারেনি, আমি কী মিথ্যা বলছি? অনুসন্ধানে সব সত্য বেড়িয়ে আসার পরেই পাল্টে যান মোছা. শিরিনা আক্তার। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যাই হইছে, এসব বাদ দেন। আমার দু’সন্তান আছে। অনেকেই তো মিথ্যা কাগজপত্র বানিয়ে ভাতা নিচ্ছে, সত্য যেহেতু জেনে গেছেন। তাহলে সবই বলছি, এরপরে তিনি প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেন।
এদিকে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড গৌরীপুর শাখায় গিয়ে জানা যায়, মোছা. শিরিনা আক্তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বিপরীতে ৫লাখ টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণের গ্যারেন্টার হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন। তিনি জানান, ঘটনা শুনেছি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। আমি জানতাম না, সে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম বলেন, আমাদের নিকট যেসকল কাগজপত্র জমা দিয়েছে যাছাই-বাচাই করে ভাতা ও ঋণের জন্য সুপারিশ করেছিলাম। প্রতারণা করে থাকলে তার দায় একান্তই নিজস্ব। গৌরীপুর সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফজলে নূর বলেন, মোছা. শিরিনা আক্তার নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। তার জমাকৃত কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শতভাগ নিশ্চিত হয়েই ব্যাংক ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছিল। ব্যাংকে জামিনদারও নেয়া হয়েছে। প্রতারণার বিষয়টি নিশ্চিত হলে ঋণ আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ও ঋণ মঞ্জুর প্রদান কমিটির সভাপতি ভারপ্রাপ্ত ইউএনও আফরোজা আফসানা বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভাতা উত্তোলনের বিষয়টি প্রমাণিত হলে প্রতারণার অভিযোগে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।