আজ শুক্রবার ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

||
  • প্রকাশিত সময় : মে, ১১, ২০২০, ৬:২৫ অপরাহ্ণ




করোনাযোদ্ধা একজন বাবলি

রাইসুল ইসলাম, ময়মনসিংহ :

‘ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন’ প্ল্যাকার্ড হাতে ছুটছেন এক নারী। মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস এবং মাথায় মপ ক্যাপ। কখনো খালি গলায় আবার কখনো হ্যান্ডমাইকে করোনা সতর্কতামূলক নানা আহ্বান জানাচ্ছেন তিনি। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বার্তা দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বাবলি আকন্দ এভাবেই স্থানীয় ভাটিকাশর ও বলাশপুরসহ আশপাশের এলাকার সড়কের অলিগলি, চায়ের দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জমায়েত এড়াতে দিন-রাত এক করে হন্যে হয়ে ছুটছেন। এ কাজ শুরুর প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতেন। বিদ্রুপ করতেও ছাড়েননি অনেকে। এই বিদ্রুপের জেরেই একদল তরুণ তার নাম দিয়ে বসে ‘করোনা আপা’। অবশ্য পরিস্থিতি দ্রুতই বদলেছে। এখন সবাই তাকে ভালোবেসেই ‘করোনা আপা’ বলে ডাকেন। তাই আগের মতো ডাকটি আর খারাপ লাগে না বাবলির। অস্বস্তির বদলে বরং আনন্দ হয়। বিদ্রুপ নয়, সম্মান বলে মনে হয় এই ডাকটা।

স্থানীয় একটি দৈনিকের সংবাদকর্মী বাবলি আকন্দ। তিনি করোনার দাপটের মুখে সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শের পাশাপাশি সচেতনতার সঙ্গে সতর্কতা অবলম্বের পরামর্শ দিয়েই সময়ের ব্যবধানে সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। ফলে পথ চলতেই ‘করোনা আপা’ গেঁথে গেছে বাবলি আকন্দেরও। এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাবলির সঙ্গে যোগ হয়েছেন নিয়মিত-অনিয়মিত ২০ স্বেচ্ছাসেবক। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যরকম মানবিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া বাবলির ডাকে সত্যি সত্যিই তারা সাড়া দিয়েছেন।

নিজ এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে খাবার বা চাল না থাকলেই ডাক পড়ে ‘করোনা আপা’র। তারা ফোন করেন বাবলি আকন্দকে। অসহায় মানুষকে সহায়তার উদ্দেশ্যে বাবলি এই বার্তা পৌঁছে দেন জেলা প্রশাসক, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা সমাজের বিত্তবানদের কাছে। ব্যস, খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা হচ্ছে নিমিষেই। ফলে করোনার এই সংকটময় মুহূর্তেই রীতিমতো ‘ত্রাতা’র ভূমিকায় দেখা মিলেছে এই নারীকে।

জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় এবং লকডাউন কার্যকরে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করি। বাবলি সেই দলের একজন সক্রিয় সদস্য। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।’

হার না মানা শুরুর গল্প

দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর খবর মেলে গত ৮ মার্চ। ঘটনাচক্রে তারিখটি সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসেবে। এরপর থেকেই একজন নারী হিসেবেই সাধারণ মানুষকে সুরক্ষার বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মী বাবলি আকন্দের মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু কঠিন এই যুদ্ধে সঙ্গী ছাড়া লড়াইয়ের কোনো জো নেই যেন! নিজের ইচ্ছা পূরণে দ্বারস্থ হলেন বন্ধুদের কাছে। কেউ রাজি আবার কেউ ভয় দেখাচ্ছেন। কিন্তু ‘যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’এ মর্মবাণী যেন বাবলির হৃদয়তন্ত্রীতে গাঁথা। সাধারণ সুরক্ষাসামগ্রী পরেই হ্যান্ডমাইক হাতে নেমে পড়লেন। তার সাহস অনুপ্রাণিত করল বন্ধুদেরও। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সেই বন্ধুরাও পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাদের নিয়েই শুরু হলো অন্যরকম এক মানবিক লড়াই।

করোনা প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে নিত্যদিন নগরীর ভাটিকাশর, বলাশপুরসহ আশপাশের এলাকার সড়ক, অলিগলি ও বাজারে শুরু করলেন ছোটাছুটি। বাবলি নিজের মুখেই বলছিলেন, ‘কঠিন এই যুদ্ধে নামার সময়ে পরিবারের সমর্থন পেয়েছি। বাসায় তিন বছর বয়সী সন্তান থাকায় প্রথমে মা সাহস করেননি। কিন্তু আমার আইনজীবী স্বামী পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। মানুষের পাশে দাঁড়াতে আমাকে সব রকমের সহযোগিতা করেছেন।’

নিজে যখন যুদ্ধে নেমে গেছেন ঠিক সেই সময়েই একটি সুসংবাদ আসে বাবলির কানে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করা হচ্ছে। বাবলি যথারীতি সব নিয়মকানুন মেনে ফরম পূরণ করেন। হয়ে যান জেলা প্রশাসনের অনুমোদিত ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবী।

বিদ্রুপ থেকে বন্ধুত্ব

কঠোর প্রতিবন্ধকতা ভেদ করেই করোনাবিরোধী লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করেন গণমাধ্যমকর্মী বাবলি আকন্দ। সেই সময়ের কথা জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘এলাকার সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে যখন রাস্তায় নামলাম তখন অনেকেই দুয়ো ধ্বনি দিত। এলাকার ছেলেরা আড়াল থেকে ‘করোনা ভাইরাস’ বলে বিদ্রুপ করত। এমনকি আমাদের এলাকার মুরব্বিরাও বিষয়টিকে আড় চোখে দেখতে শুরু করলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি দোকানকে জরিমানা করলে সেই দোকানদাররাও আমাকে দায়ী করে নালিশ জানিয়েছেন। এসব কর্মকান্ড দেখে আমার কষ্ট হতো। কঠোর মনোবলের অধিকারী বাবলি বলছিলেন, ‘আমি হাল ছাড়ার মেয়ে না। আমি আমার অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির জোরেই কাজ চালিয়ে গেলাম। এলাকায় ঘুরে ঘুরে দোকানপাট বন্ধ রাখা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে গেলাম।’

এখন সবাই খোঁজেন ‘করোনা আপা’কে

সময় গড়াতেই এলাকার মানুষজন রীতিমতো আপন করে নিয়েছেন বাবলিকে। এখন ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কোনো ঘরে চাল বা খাবার না থাকলেই তারা প্রথমেই ফোন করেন জেলা প্রশাসনের স্বেচ্ছাসেবী বাবলিকে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাবলিকে ডাকা মানেই সব সমস্যার সমাধান। বাবলিও তাদের নিরাশ করেন না। অসহায় মানুষের খাবার সংকটের কথা পৌঁছে দেন জেলা প্রশাসক, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা সমাজের বিত্তবানদের কাছে। তারাও যথারীতি সাড়া দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মনের গতি-প্রকৃতিও পরিবর্তন হয়েছে। বাবলি দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন তার দুঃসময়ের কথা। পাশাপাশি তার ভালোবাসার ‘করোনা আপা’র সার্থক পরিণতির বিষয়টিও জানান এভাবে ‘একসময় যারা আমাকে দেখলেই দুয়ো ধ্বনি দিতেন, এখন তারাই উৎসাহ দিচ্ছেন। কোনো সমস্যায় পড়লেই আমাকে জানাচ্ছেন।’

বাবলি বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের বরাদ্দকৃত ত্রাণ ও খাদ্যসহায়তা কাউন্সিলরের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে হতদরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ সহায়তা পেয়ে অনেক খুশি।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০