শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪ -|- ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০-বসন্তকাল -|- ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

এভাবেই একদিন ফুরিয়ে যাবে বেলা

প্রকাশিত হয়েছে- শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : মার্চ, ২৭, ২০২০, ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বাহাদুর ডেস্ক :

দুনিয়ার আগুনের উত্তাপ কি আমরা সহ্য করতে পারি? আমাকে যদি বলা হয়, ভাই, তোমাকে বিপুল পরিমাণ টাকা-পয়সা দেয়া হবে, তুমি পাঁচ মিনিটের জন্য তোমার খালি হাত দুটো আগুনের ওপরে রাখ। আমি কি বোকার মত এ কাজ করব?

কখনোই করবো না। শুধু আমি কেন, সামান্যতম জ্ঞান-বুদ্ধি যার আছে, সেও করতে যাবে না। কারণ, এতে তার হাত পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। দীর্ঘক্ষণ আগুনের ওপরে হাত রাখলে মৃত্যুর আশঙ্কাও দূরে রাখা যায় না!

এ হল দুনিয়ার আগুন, যাকে আমরা প্রাণনাশক জ্ঞান করি। ভয় পাই। এর থেকে দূরে থাকি।

আমরা রাতে যখন ঘুমাতে যাই, তখন রান্নাঘরে গিয়ে আগে ভালোভাবে দেখে নেই, চুলাটা বন্ধ করা হয়েছে কিনা! নয়তো যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়; তাই সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করি, যেন আমাদের কিছু না হয়। পরিবারের সবাই যেন ভালো থাকে। আগুন থেকে নিরাপদ থাকে।

আজ আমি আপনাদের এমন এক আগুনের কথা বলব, যাকে আরও বেশি ভয় করা দরকার। যার থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা দরকার। কারণ, এ আগুন দুনিয়ার আগুনের মত নয় । তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি যার উত্তাপ!

যে কারও সঙ্গেই আপোষ করে না। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। জলজ্যান্ত বস্তুকে মুহূর্তের মধ্যেই ছাই করে দেয়। সেটা হল জাহান্নামের আগুন। যে আগুন কারও পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব নয়।

নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমরা দুনিয়াতে যে আগুন ব্যবহার করো, জাহান্নামের আগুন তার চেয়ে ৭০ গুণ বেশি উত্তাপ সম্পন্ন হবে।

এক সাহাবী প্রশ্ন করেছিলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), জাহান্নামীদের শাস্তি প্রদানের জন্য দুনিয়ার আগুনই তো যথেষ্ট ছিল, কারণ এর দাহ্যশক্তিও তো কম নয়!

প্রতিউত্তরে নবিজী (সা.) বলেন, দুনিয়ার আগুনের ওপরে তার সমপরিমাণ তাপ সম্পন্ন জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা আরো ৬৯ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। (বুখারী মুসলিম)

প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবিজী (সা.) বলেছেন, জাহান্নামের আগুনকে প্রথমে এক হাজার বছর পর্যন্ত জ্বালানো হয়েছে ; ফলে তা লাল হয়ে গেছে। তারপর ১০০০ বছর পর্যন্ত জ্বালানো হয়েছে ; ফলে তা সাদা হয়ে গেছে।

অতঃপর আরও ১০০০ জ্বালানো হলে, তা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। আর এই মুহূর্তে জাহান্নামের আগুন ভয়ঙ্কর কালো অবস্থায় রয়েছে। (তিরমিযী)

এই আগুন থেকে বাঁচার জন্য আপনি কতোটা ফিকির করেছেন? কতোবার নিজের কৃত গোনাহের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে অনুতপ্ত হয়েছেন? নির্জনে বসে বসে কখনও কি ভেবে দেখেছেন, আপনার জীবনের বড় একটি অংশ অতিবাহিত হয়ে গেছে, অথচ আখেরাতের জন্য আপনার কিছুই করা হয়নি?

মৃত্যুর পরে আল্লাহ তায়ালার সামনে উপস্থাপন করার মত কোনো পুঁজি এখনও আপনার গ্রহণ করা হয়নি? দুনিয়ার আগুন থেকে বাঁচার জন্য কতো কিছু করি, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য কোনো কিছুই করি না।

রাতে যখন সবাই ঘুমে বিভোর থাকত, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) তখন জেগে থাকতেন। নামাজ পড়তেন। নিজের পা-দুটো ফুলিয়ে ফেলতেন। রক্ত ঝরতো তা থেকে। তবুও নামাজ ছাড়তেন না। পড়তেই থাকতেন। বড় বড় সুরা পড়তেন।

এক সাহাবী প্রশ্ন করেছিল, হে আল্লাহর নবী, আল্লাহ তায়ালা তো আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, তবুও আপনি এতো নামাজ কেন পড়েন ?

উত্তরে নবীজী বলেছিলেন, আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বাপর সব গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, এজন্য তার কৃতজ্ঞতা কি আমি আদায় করবো না?

আরেক হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম দিনে কমপক্ষে ৭০ বার আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।

আমাদের নবীজির তো কোনো গোনাহ ছিল না; তবুও তিনি দিনে ৭০ বার ইস্তেগফার করতেন। আমাদের কি গোনাহ নেই? আমরা কি আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হইনি কখনও? আমরা কি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেইনি? সুদ খাইনি? ঘুষ খাইনি? ব্যভিচারে লিপ্ত হইনি? অপর ভাইকে ঠকাইনি? গরীব-অসহায়কে মারধর করিনি? আমরা তো সবই করেছি, শুধু আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাটাই করিনি।

হাদিসে আছে, হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রায়শই বনজঙ্গলে চলে যেতেন। সেখানে গিয়ে নিজের বুক চাপড়াতেন আর কাঁদতেন, হে আল্লাহ, আমাকে যদি তুমি ঘাস বানাতে! জীবজন্তু আমাকে খেয়ে ফেলতো; তাহলে আমার আর কোনো হিসাব হতো না! এখন এই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব আমি কীভাবে দিব? তোমার সামনে কী নিয়ে দাঁড়াব?

প্রিয় পাঠক, হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সেই সাহাবিদের একজন, যারা দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তবুও তিনি আখেরাতের ব্যাপারে এতো চিন্তিত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালার সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয়ে রাতে তিনি ঘুমাতে পারতেন না। ছটফট করতেন।

ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) মাঝেমাঝেই কবরস্থানে চলে যেতেন। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুব কাঁদতেন। এতে তাঁর দাঁড়িগুলো পর্যন্ত ভিজে যেত।

একবার কেউ তাঁকে প্রশ্ন করল , জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করা হলেও তো আপনি এতো কাঁদেন না, অথচ এই কবরের পাশে দাঁড়ালে আপনি এতো অধিক কাঁদেন, কারণ কী ?

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আখেরাতের মনজিলগুলোর মধ্যে কবর হল প্রথম মানজিল। এখান থেকে কেউ মুক্তি পেয়ে গেলে পরবর্তী মনজিলগুলোতেও সে খুব সহজেই মুক্তি পেয়ে যাবে। আর যে এখানে মুক্তি পাবে না, তার জন্য পরবর্তী মনজিলগুলো খুব কঠিন হয়ে যাবে।

সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) একদিন তার স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে খুব কাঁদতে লাগলেন। তার কান্না দেখে তার স্ত্রীও কাঁদতে লাগল।

আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন কাঁদছ? স্ত্রী বলল, তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না চলে এসেছে। সাহাবী বললেন, আমি যে কাঁদছি, এর কারণ হল আল্লাহ তায়ালার এ বাণীটি আমার মনে পড়ে গেল, তোমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই, যে জাহান্নামের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে না। (সুরা: মারইয়াম আয়াত : ৭১)

আর আমার জানা নেই, জাহান্নামের ওপর স্থাপন করা পুলসিরাত অতিক্রম করার সময় আমি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবো কিনা! (মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীস ৮৭৮৬)

আল্লাহর রাসূলের সাহাবী হওয়া সত্বেও আখেরাতের ব্যাপারে তাদের কতো ভয়! কতো শঙ্কা! আর আমাদের তো কোনো খবরই নেই! এব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ উদাসীন। যেন কেউ আমাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে।

নবীজীর প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত আয়েশা ( রা.) একবার দোজখের কথা মনে করে খুব কাঁদতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কে তোমাকে কাঁদাল? আয়েশা (রা.) উত্তরে বললেন, আমি দোযখের ভয়ে কাঁদছি।

আপনি কি কেয়ামতের দিন আপনার পরিবারের কথা মনে রাখবেন? নবীজী (সা.) বললেন, তিন জায়গায় কেউ কাউকে মনে রাখতে পারবে না।

(এক) মীযানের (আমল পরিমাপক যন্ত্র) কাছে। যতক্ষণ না জানতে পারবে, তার নেকীর পাল্লা ভারী হয়েছে না হালকা।

(দুই) আমলনামা পেশ করার সময়, যখন বলা হবে এসো, তোমার আমলনামা পাঠ করে নাও; যতক্ষণ না জানতে পারবে, তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হচ্ছে, না পিঠের পেছন থেকে বাম হাতে।

(তিন) পুলসিরাতের ওপর দিয়ে অতিক্রম করার সময়; যখন তা জাহান্নামের ওপর স্থাপন করা হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭২২)

নবিপত্নী হয়েও যার আখেরাতের ভয়ে এতো বেশি কাঁদতে হয়, তখন আমার-আপনারমত গোনাহগারদের কবরের শাস্তির ভয়ে কতো বেশি চোখের পানি ফেলা উচিত? কতোবার আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত?

আজকে যদি আমি গোনাহ থেকে বাঁচতে না পারি, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় না করতে পারি, তাহলে আর কখনও সুযোগ নাও আসতে পারে! আল্লাহ না করুন, যদি এই গোনাহের হালতে আমার পরপারের ডাক এসে যায়, তাহলে সেই অনন্তকালে আমার দুঃখের কোনো সীমাপরিসীমা থাকবে না।

লেখক: তরুণ আলেম ও চিন্তক

muhammadbinwahid96@gmail.com

টি.কে ওয়েভ-ইন