আজ শুক্রবার ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

||
  • প্রকাশিত সময় : মে, ২৬, ২০২০, ৯:২৭ অপরাহ্ণ




একই বৃন্তে দুটি কুসুম : লুৎফর রহমান

সোমেন চন্দ বাংলা সাহিত্যের একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী। তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে এবং মৃত্যু ১৯৪২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে। ধুমকেতুর মতো আগমন ও উল্কার মতো বিদায়। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সোমেন চন্দ মেট্রিক পাশ করার পর ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হয়ে ওঠেনি, স্থিতি হয় সংগ্রামে-সাহিত্যে। সময়টা ছিলো বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের গণ-অভ্যুত্থান আয়োজনের সময়। এ সময় নিষিদ্ধ সাম্যবাদীদের দলে যোগ দেন সোমেন চন্দ। তাঁর দুটো কাজ হয়, এক. ট্রেড ইউনিয়ন গড়া দুই. সাহিত্য রচনা। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত রচনার কাজটি চলে। সোমেনের ছোটগল্পের সংখ্যাই অধিক যদিও কিছু কবিতা এবং একটি উপন্যাস রয়েছে। সে সময় ট্রেড ইউনিয়নের কাজ নিষিদ্ধ হওয়ায় নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। তরুণ সোমেন চন্দের ওপর দায়িত্ব পড়ে শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগের। এটাই আশির্বাদ হয়, সোমেনের সুযোগ হয় শ্রমিকদের জীবন প্রণালী উপলব্ধির। প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে সোমেন চন্দের গল্পগুলোতে।

এই সময়টাতে প্রগতিশীল লেখকদের উপমহাদেশ ভিত্তিক একটি সংগঠন গড়ে ওঠে যার নাম ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। বিখ্যাত কবি সাজ্জাদ জহীর ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক। কয়েকজন তরুণের নেতৃত্বে ১৯৩৯ সালে ঢাকাতেও সংগঠনটির শাখা গঠিত হয় যার মধ্যে সোমেন চন্দের ভূমিকা ছিলো অন্যতম। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত রূপ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিলো এই সংগঠনের বিশেষ কর্মসূচি। ফরাসি লেখক রোঁমা রোলাঁদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগঠনকে অনুসরণ করেছিলো `প্রগতি লেখক সংঘ`। একে সংগঠনটির একটি আন্তর্জাতিক সংযোগও ধরা যেতে পারে। এ সময়ের আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়, তখন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় বিপ্লবীরা সন্ত্রাসবাদ পরিহার করে গণবিপ্লবে আস্থা স্থাপন করছিলো। ফলে শ্রমজীবীদের চেতনাগত ঐক্যের প্রয়োজন পড়েছিলো। এই কর্মটি তখন এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পড়েছিলো প্রগতিশীল লেখকদের ওপর। তাঁরা তাই মেহনতি মানুষের জীবনের সাথে সাহিত্যের সংযোগ ঘটান। এভাবে সাহিত্যে গড়ে ওঠে একটি গণমুখী ধারা। তখন প্রগতিশীল বাংলাসাহিত্য-শিল্পীদের মধ্যে তিরিশের দশকে একটি চেতনার জন্ম হয় যে, গণমুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হবে। সোমেন চন্দ এই চেতনার ফসল। সুতরাং তিনি কঠিন দায়িত্ব পালনের মানসে নিজেকে প্রস্তুত করেন। সে সময় এই ধারায় যারা যুক্ত হয়েছিলেন তারা হচ্ছেন, সতীশ পাকড়াশী, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, অমৃতকুমার দত্ত, রণেশ দাসগুপ্ত। ‘প্রগতি লেখক সংঘের’ সাথে যুক্ত হন কাজী আব্দুল ওদুদ, অচ্যুত গোস্বামী, নৃপেন গোস্বামী, সরলানন্দ সেন, জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত প্রমুখরা। এটা ছিলো ‘প্রগতি লেখক সংঘ‘-এর প্রস্তুতিকাল যেখানে সোমেন চন্দের ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। তিনি তখন সংগঠনটির জন্য নিয়মিত শ্রম দিতেন। সে সময় সোমেন চন্দ লিখিত গল্পগুলোর অধিকাংশ প্রগতি লেখক সংঘের আসরে পঠিত ও আলোচিত হয়েছিলো। এই সংগঠনটি ছিলো সোমেনের প্রেরণা।

১৯৪০ সালে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-এর উদ্যোগে ঢাকা থেকে ‘ক্রান্তি’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। সোমেন চন্দ এর সিংহভাগ কাজ করেন। এতে তাঁর গল্প ‘বনস্পতি’ স্থান পায়। পরবর্তীতে কোলকাতার পত্রিকা ‘পরিচয়’-এ তাঁর ‘ইঁদুর’ গল্পটি প্রকাশিত হয়। এই সময় পশ্চিমা দেশগুলোতে যুদ্ধ বেধে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধটা ছিলো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে যুদ্ধ। জার্মানির ফ্যাসিবাদী হিটলারের সাথে ছিলো ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির ইতালি ও জাপান সাম্রাজ্যবাদ অন্যপক্ষে আমেরিকা, গ্রেট বৃটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলোর সাথে মেহনতি মানুষের সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। মজার বিষয় হলো এই উভয় পক্ষেরই গোপন উদ্দেশ্য ছিলো শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করে ফেলা। তাই উপমহাদেশের প্রগতিশীল শক্তির মধ্যে স্বভাবতই চিন্তা আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশে দাঁড়ানোর তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার। তাঁরা সোভিয়েতের বিজয় দেখতে চায়। সে লক্ষ্যে লেখক-লেখিকারা ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে জনমত গঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ঢাকায় ১৯৪২ সালে জানুয়ারী মাসে গঠন হয় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি। সোভিয়েতের পক্ষে বিশেষ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। সেটা উদ্বোধন করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। এ সবকিছুরই পরিশ্রমী কর্মী ছিলেন সোমেন চন্দ।

এই ঘটনার পরপরই ঢাকায় সুতাকল শ্রমিকদের উদ্যোগে একটি ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন ডাকা হয়। শ্রমিকরা ধীরে ধীরে সম্মেলন-স্থানে জমায়েত হচ্ছিলো। এই সময় ফ্যাসিবাদের সশস্ত্র দালালরা সম্মেলনটি পণ্ড করার জন্য হঠাৎ আক্রমণ চালায়। তখন সোমেন চন্দ রেল শ্রমিকদের একটি মিছিল নিয়ে এখানে উপস্থিত হলে সন্ত্রাসীরা মিছিলটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সোমেন চন্দ ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে এবং সন্ত্রাসীরা তাঁকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। তিনি মূলত নেতাজি সুভাষ বসুর ফরওয়ার্ড ব্লক ও রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্যদের হাতে খুন হন। তখনো লাল নিশানটি তাঁর হাতেই ধার ছিলো। এভাবে সমাপ্তি ঘটে একটি বিপ্লবী সৃষ্টিশীল গণশিল্পীজীবনের। তিনিই এ অঞ্চলের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রথম শহীদ।

শিল্পচিন্তা, জীবনবোধ, কর্মপদ্ধতি ও গণমুক্তির বিষয় বিবেচনায় সময়কে চিহ্নিত করলে তিরিশের দশকের দুজন বিপ্লবী শিল্পীর কথা ওঠে আসে। এঁরা হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সোমেন চন্দ। সুকান্তের কবিতা ও সোমেন চন্দের ছোটগল্পের ক্ষেত্রে মিলটা হচ্ছে দুজনই গণবাস্তবতার রূপদানকারী শিল্পী। বয়স্কদের অনেকেই যখন গণমুক্তির যাত্রাপথে ছন্দে ছিলেন না তখন এই দুই তরুণ যৌবনের সজিবতায় ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে শিল্পসম্মতভাবে সামনে এগিয়েছিলেন। এঁরা চিরঞ্জীব, বাংলাসাহিত্যে প্রগতির একই বৃন্তে দুটি কুসুম।

(চলবে)——–

২৫/০৫/২০২০ খ্রিঃ।




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০