মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৩রা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ইসলামের দৃষ্টিতে গোসল, গোসলের প্রকার

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০
||
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ২৮, ২০২০, ৭:২৯ অপরাহ্ণ

ইসলাম ও জীবন ডেস্ক :

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। গোসল আমাদের প্রতি দিনের নিয়মিত একটি কাজ, যেহেতু আমরা মুসলিম তাই গোসলের মধ্যে আল্লাহর কি হুকুম আহকাম রয়েছে তা জানা আমাদের প্রত্যেকের উপর জরুরি, নিম্মে গোসল সম্পর্কে  সংখেপে আলচনা করা হলো ।

ইসলামের দৃষ্টিতে গোসল (Gosol)

কুরআন মাজীদে আছে

নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক পবিত্র লোকদের ভালবাসেন”।

আমাদের মহানবি (স) বলেছেন-

পাক-পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।”

গোসল তিন প্রকার –

  • ফরয গোসল
  • ওয়াজিব গোসল
  • সুন্নত বা মুস্তাহাব গোসল।

গোসল মানে পুরো শরীর ধোয়া। ইসলামি ফেকাহ মতে শরীয়তের দেয়া বিশেষ পদ্ধতি অনুযায়ী নাপাক দুর করার উদ্দেশ্যে অথবা সওয়াবের আশায় পুরো শরীর ধোয়াকেই গোসল বলে।

তবে গোসলের জন্য উত্তম নিয়ম হলো, গায়ে কাপড় রেখে গোসল করা। মানুষের সচারাচর যাতায়াত আছে এমন স্থানে নয় বরং আড়ালে-আবডালে গোসল করা।

নারীদের বসে গোসল করার মঙ্গলজনক।

পুরুষদের গায়েও কাপড় না থাকলে বসেই গোসল করা উচিত। তবে শরীর জুড়ে কাপড় থাকলে দাঁড়িয়ে করলেও বাঁধা নেই।

গোসল অবস্থায় নিরব থাকাটাই ভালো। তবে প্রয়োজনের কথা যেতে পারে।

গোসল অবস্থায় গায়ে একেবারে কাপড় না থাকলে কেমলামুখি হওয়া উচিত না।

গোসলের জায়গা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া চায়। যে জায়গায় গোসল করবেন সেখানে মোটেও পেশাব করা সমীচিন নয়।

গোসলের সুন্নত পদ্ধতি :

ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নেবে। শরীরে নাপাক লেগে থাকলে পরিস্কার করবে। দুই হাত ভালোভাবে ধুয়ে অজু করবে। কুলির সময় গলায় ও নাকের ভেতর ভালো করে পানি পৌঁছাতে হবে। গোসলের স্থানে পানি জমা হয়ে থাকলে গোসলের পর পা ধুয়ে নেবে। ফরজ গোসল হলেও অজুতে শুধুই বিসমিল্লাহই পড়বে। অন্য কোন দোয়ার প্রয়োজন নেই। অজু শেষে গায়ে পানি ঢালবে। তারপর প্রথমে ডান ও পরে বাম কাঁধে পানি ঢলবে। পুরো শরীর ভালোভাবে ঘষতে হবে। সামান্য অংশ যেন শুকনো না থাকে এবং শরীর ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়। একাধিকবার পুরো শরীরে পানি দেওয়া যেতে পারে। অজুর সময় পা ধুয়ে না থাকলে এবার পা ধুয়ে নিতে হবে এবং সারা গা মুছতে হবে। শরিয়ত মতে গোসল আদায় হয়ে গেল।

গোসলের ৩ ফরজ :

কুলি করা, তবে গলার ভেতরে পানি পৌঁছাতে হবে (রোজা অবস্থায় শীতিলযোগ্য)
নাকে পানি দেওয়া
পুরো শরীর ধোয়া। এক চুলও যেন শুকনো না থাকে।

এ তিনটির কোন একটি ছুটে গেলে গোসল হবে না। শরীরও পাক হবে না।

গোসলের সুন্নত

    আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গোসল করা;

  • ২. ক্রম বজায় রাখা;
  • ৩. প্রথমে ওজু করা;
  • ৪. দু হাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া;
  • ৫. শরীর থেকে নাপাকি ঘষে দূর করা;
  • ৬. মেছওয়াক করা ও
  • ৭. সারা দেহে তিনবার পানি ঢালা।

গোসলের মুস্তাহাব

    উঁচু স্থানে বসে গোসল করা যাতে পনি গড়িয়ে যায় ও গায়ে ছিটা না লাগে;

  • ২. পানির অপচয় না করা;
  • ৩. বসে গোসল করা;
  • ৪. লোক সমাগম স্থানে গোসল না করা;
  • ৫. পাক জায়গায় গোসল করা ও
  • ৬. ডান থেকে শুরু করা ।

মেয়েদের গোসলের নিয়মইসলামের দৃষ্টিতে গোসল

মেয়েদের পুরো শরীর ধোয়া হলো ফরজ। তাদের খোঁপা যদি এমন হয় চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছতে কোনো অসুবিধা না হয় তাহলে খোলার প্রয়োজন নেই। তবে চুল যদি খুব ঘন হয় অথবা খোঁপা এমন শক্ত করে বাঁধা হয় যা না খুললে পানি পৌছবে না, তাহলে নারীর মাথার খোঁপা খুলতে হবে।

চুল যদি খোলা হয় তাহলে সব চুল ভিজানো এবং গোড়া পর্যন্ত ভালো করে পানি পৌছাতে হবে যেন একটিও চুল শুকনো না থাকে।

পুরুষ যদি লম্বা চুল রাখে এবং মেয়েদের মতো খোঁপা বাঁধে অথবা এমনি একত্রে বেঁধে রাখে, তাহলে খুলে প্রত্যেক চুল ও চোলের গোড়ায় পানি পৌঁছাতে হবে।

নারী-পুরুষের আঙটি, এমন সব অলংকার যা ছিদ্র করে পরা হয়, যেমন নাকের বালি, কানের রিং বা দুল ইত্যাদির নেড়ে- চেড়ে এসব অলঙকারের নীচে পানি পৌঁছাতে হবে।

ফরজ গোসলের নিয়ম

ফরজ গোসলের সঠিক নিয়ম না জানার কারণে অসংখ্য মুসলিম ভাই- বোনের সালাত সহ নানা আমল কবুল হয় না। যেটা ঈমানের ক্ষেত্রে চরম ভয়ানক ব্যাপার।

যে সব কারণে গোসল ফরজ হয়ঃ

  • ১. স্বপ্নদোষ বা উত্তেজনাবশত বীর্যপাত হলে। স্বপ্নের কথা স্মরণ থাকুক বা না থাকুক শরীরে, কাপড়ে বা বিছানায় বীর্যের চিহ্ন দেখতে পেলে।
  • ২. নারী-পুরুষ মিলনে (সহবাসে বীর্যপাত হোক আর নাই হোক)।
  • ৩. মেয়েদের হায়েয-নিফাস শেষ হলে।
  • ৪. ইসলাম গ্রহন করলে(নব-মুসলিম হলে)।

মুর্দাকে গোসল দিলে এবং জুমু’আর সালাতের জন্য গোসল করা সুন্নাত। (মিশকাত হাঃ ৪১৫, ৪১৯, ৪২১)।

ফরজ গোসলের সঠিক নিয়মঃ-

গোসলের পূর্বে পেশাব করে নেওয়া উচিত।

  • ১. গোসলের জন্য মনে মনে নিয়্যাত করতে হবে। বাড়তি মুখে কোন আরবি শব্দ উচ্চারণ করে নিয়্যাত করা বিদ’আত।
  • ২. প্রথমে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ৩ বার ধুতে হবে।
  • ৩. এরপর ডানহাতে পানি নিয়ে বামহাত দিয়ে লজ্জাস্থান এবং তার আশপাশ ভালো করে ধুতে হবে। শরীরের অন্য কোন জায়গায় বীর্য বা নাপাকি লেগে থাকলে সেটাও ধুতে হবে।
  • ৪. এবার বামহাতকে ভালো করে ধুইয়ে ফেলতে হবে।
  • ৫. এবার ওজুর নিয়মের মত করে ওজু করতে হবে তবে দুই পা ধুয়া যাবে না।
  • ৬. ওজু শেষে মাথায় তিনবার পানি ঢালতে হবে
  • ৭. এবার সমস্ত শরীর ধোয়ার জন্য প্রথমে ৩ বার ডানে তারপরে ৩ বার বামে পানি ঢেলে ভালোভাবে ধুতে হবে, যেন শরীরের কোন অংশই বা কোন লোমও শুকনো না থাকে। নাভি, বগল ও অন্যান্য কুঁচকানো জায়গায় পানি দিয়ে ধুতে হবে।
  • ৮. সবার শেষে একটু অন্য জায়গায় সরে গিয়ে দুই পা ৩ বার ভালোভাবে ধুতে হবে।

মনে রাখতে হবেঃ

  • ১. পুরুষের দাড়ি ও মাথার চুল এবং মহিলাদের চুল ভালোভাবে ভিজতে হবে।
  • ২. এই নিয়মে গোসলের পর নতুন করে আর ওজুর দরকার নাই, যদি ওজু না ভাঙ্গে।

কেননা হযরত ‘আয়েশা রা. বলেন,

নবী মুহাম্মদ সা. ফরজ গোসলের পর আর ওযূ করতেন না। [তিরমিযী : ১০৩, মিশকাত : ৪০৯]

* রাসূল সা. এক মুদ্দ (৬২৫ গ্রাম) পানি দিয়ে ওযূ এবং অনধিক পাঁচ মুদ্দ (৩১২৫ গ্রাম) বা প্রায় সোয়া তিন কেজি পানি দিয়ে গোসল করতেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপচয় করা ঠিক নয়।

* নারী হউক পুরুষ হউক সকলকে রাসূলুল্লাহ সা. পর্দার মধ্যে গোসল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

ফরজ গোসলে অবহেলার শাস্তিঃ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদা আমি আমার এক প্রতিবেশীর জানাযাতে যোগদান করি। তার লাশ কবরে নামানোর সময় বিড়ালের ন্যায় একটি অদ্ভুত জানোয়ার কবরের ভিতরে বাইরে লম্বঝম্প করে লাশ কবরে নামাতে বাধার সৃষ্টি করতে লাগল।

সেটিকে তাড়াবার জন্য সকলে মিলে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন প্রকারই দূর করা গেল না। ব্যর্থ হয়ে অন্যত্র গিয়ে কবর খনন করা হল। সেখানে গিয়ে জন্তুটি ভয়ানক উৎপাত করতে লাগল। সেটিকে মারতে গিয়েও সর্ব প্রকার চেষ্টা ব্যর্থ হল। অগত্যা বাধ্য হয়ে অন্যত্র গিয়ে তৃতীয় কবর খনন করা হল। সেখানে গিয়েও জন্তুটি আরও বেশী উপদ্রব শুরু করল।

অনন্যোপায় হয়ে আমরা তাড়াতাড়ি তৃতীয় কবরেই তাকে দাফন করতঃ সভয়ে দ্রুতপদে সেখানে হতে প্রস্থান করলাম। দাফনান্তে কবর হতে বজ্রবৎ ভীষণ এক আওয়াজ বের হয়েছিল। আমি জানার জন্য তার স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তার স্ত্রী উত্তর দিল, সহবাসের পর তিনি ফরজ গোসলে অবহেলা করতেন। এতে তার ফজরের নামায কাযা হয়ে যেত। এছাড়া তার অন্য কোন পাপ আমি কখনো দেখি নাই।

ওয়াজিব গোসল

জুম ‘আর দিন গোসল করা ওয়াজিব। এর গোসলের বাকি নিয়ম সব একই ।

——————–

প্রশ্ন : সহবাসের কতক্ষণ পর ফরজ গোসল দিতে হয়? এ রকম কোনো সময়সীমা আছে কি?

উত্তর : না, সহবাসের কতক্ষণ পর গোসল করতে হবে, তার কোনো সময়সীমা নির্ধারিত নেই। তবে নবী করিম (সা.)-এর আমল এবং সালফে সালেহিনের আমল মতে, যত দ্রুত সম্ভব ফরজ গোসল করাটাই হলো সুন্নাহ। এটিই গুরুত্বপূর্ণ। তাই যত দ্রুত সম্ভব ফরজ গোসল আদায় করা উচিত।
প্রসঙ্গত, ফরজ গোসলের সঠিক নিয়ম না জানার কারণে অসংখ্য মুসলিম ভাই- বোনের সালাত সহ নানা আমল কবুল হয় না। যেটা ঈমানের ক্ষেত্রে অত্যান্ত লক্ষনিয় বিষয ।