বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

আমাদের একমাত্র অরাজনৈতিক সর্বজনীন উৎসব-অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত হয়েছে- বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২
অজয় দাশগুপ্ত || প্রাবন্ধিক
  • প্রকাশিত সময় : এপ্রিল, ১৪, ২০২২, ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ইতিহাস বলছে: প্রাচীনকালের মানুষ যারা চন্দ্র-সূর্যের গতি লক্ষ করে বছর গণনা করতে জানত না, তারা অগ্রহায়ণ (অগ্র অর্থাৎ প্রথম, হায়ন অর্থ বৎসর) মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে বিবেচনা করত। এবং এই মাস থেকে নতুন বৎসর গণনা করত। এর পেছনে কারণ ছিল কৃষিপ্রধান এই দেশে সেই সময়ে কৃষকের ঘর নতুন ফসলে ভরে উঠত। তাই তাদের কাছে হেমন্ত ঋতুর অগ্রহায়ণই ছিল শ্রেষ্ঠ মাস, মার্গশীর্ষ বা প্রথম মাস। নববর্ষের এই ভাবনা একান্তই সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামীণ কৃষিজীবীদের মধ্যে।

তখন চৈত্র শেষে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে হতো গাজন, চড়ক। এটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা প্রধানত নিম্নবর্গের মানুষরা পালন করতেন। অন্য দিকে ফসল তোলা শেষ হওয়ার পর যে পুণ্যাহ উৎসব পালন করা হতো, তার সঙ্গে জড়িত ছিল মানুষের অর্থনৈতিক জীবন। এক দিকে রাজস্ব জমা দেওয়া হতো, তার সঙ্গে বাকি রাজস্ব ছাড় করা হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে রাজস্ব দিতে না পারলে তাও মওকুফ করা হতো। জমিদাররা এই সময় প্রজাদের ঋণ দিতেন। রায়তরা জমিদারের কাছারিতে একত্রিত হয়ে জমিদার বা নায়েবের কাছ থেকে পান বা পানপাতা উপহার পেতেন। এই দিনটি ছিল সামাজিক আদান-প্রদানের দিন। স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে সেই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে। ক্রমে তা গোটা সমাজ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে যা ছিল শুধু কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয়, একসময় তা হয়ে উঠল নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা, তার সঙ্গে নব জীবনের আহ্বান। যা কিছু অসুন্দর, জীর্ণ, পুরাতন, তা শেষ হয়ে যাক। পহেলা বৈশাখ সেই শুভ সূচনার দিন। গত বছরগুলো করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে কোনও ভাবে উদযাপিত হয়েছিল বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসব। বলতে গেলে ঘরের বাইরে বের হতেই পারেনি মানুষজন। এবার আশা করা যাচ্ছে মানুষ খোলামেলা ভাবে উদযাপন করতে পারবে এই উৎসব। সে দিকটা বাদ দিলে যা থাকে তা হচ্ছে সময় আর সমাজের বাস্তবতা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, বাঙালিয়ানা সবই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। শুরুতে বলে রাখি এখন পর্যন্ত কথা আছে মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে। যদিও তা সীমিত পরিসরে। টিএসসি থেকে উপাচার্যের বাসভবন। এই যাত্রা পথ শুভ ও নিরাপদ হবে এ আশাই রাখছেন সকলে।

যে বিষয়গুলো এতকাল নির্ধারিত ছিল, ছিল অপরিহার্য সেগুলো এখন বিতর্কিত হয়ে উঠছে। কীভাবে বিতর্কিত হলো বা কারা করল সবাই জানে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একদা এই মানুষগুলো ছিল সংখ্যালঘু, যাদের হৈ চৈ সমাজে কোনও প্রভাব ফেলত না। এখন পরিবেশ পাল্টে গেছে। এরাই বলতে গেলে নিয়ন্ত্রক। একদিনে বা একক কোনও আমলে তা হয়নি। ষড়যন্ত্রকারীদের বাধাহীন সমর্থনে তারা ফুলে ফেঁপে আজ শক্তিশালী। এই শক্তির পেছনে আমাদের সবথেকে বড় দুর্বলতা হলো নিশ্চুপ থাকা। যারা সবকিছুতে চুপ থাকে তারা জীবন্মৃত। এমন সমাজ আমরা আগে কখনো দেখিনি। কখনো এত মেনে নেওয়া দেখেনি বাঙালি।

বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাঙালির সংগ্রাম আর দ্রোহের ইতিহাস সোনার অক্ষরে লেখা। আসুন একটু সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দিকে তাকাই। গর্ব জিনিসটা নিচুস্তরের অনুভূতি। ওটা না থাকলেই ভাল। কিন্তু আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস সম্বন্ধে সে কথা বলা চলে না। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য থেকে আমরা প্রচুর আনন্দ পাই। আমাদের বাংলা ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষার একটা। এই চেতনা গর্ব না, সুখকর চিন্তা, আমাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি। যদি বঙ্কিম-নজরুল-রবীন্দ্রনাথের ভাষা ভুলে গিয়ে টেঁশু মার্কা ‘আরে ইয়ার’ জাতীয় ভাষাকে যদি মাতৃভাষা বলে আমরা বরণ করি, তা হলে আমাদের সংস্কৃতি গতি হারাবে। শুভ দিনে বাংলায় গুরুজন, প্রিয়জনকে চিঠি লেখা, গুরুজনদের প্রণাম, প্রিয়জনদের আলিঙ্গন, নিজেদের ভাষায় বাক্যালাপ এই সব প্রথা জীবনকে সানন্দ করে, নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিশ্বাস মারফত যাবতীয় হীনম্মন্যতার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, বিশ্বায়নের যুগে আত্মসম্মান বোধকে বাঁচিয়ে রাখে। বাঙালি বছর, মাসগুলির সঙ্গে তেরো পার্বণ, তথা অসংখ্য সুখাদ্যের স্মৃতি আমাদের সংস্কৃতি যে কত আনন্দময়, তা স্মরণ করিয়ে দেয়। পহেলা বৈশাখ সেই বছরের শুরু। নানা আনন্দের পসরা সাজিয়ে এর পর বারো মাস আসবে।

এইসব নিয়মগুলো কি এখন নির্বিঘ্নে পালন করা যায়? না পালন করা সহজ? বাংলা নববর্ষকে আপনি যেভাবেই দেখেন না কেন এটিই হচ্ছে আমাদের একমাত্র অরাজনৈতিক সর্বজনীন উৎসব। আমাদের বেশিরভাগ উৎসবের জন্ম রাজনীতির গর্ভে। বাংলা নববর্ষ রাজনীতি বর্জিত এক চমৎকার উৎসব যার পরতে পরতে বাঙালি হবার ডাক। হয়তো সে কারণেই একদল মানুষের তা ভালো লাগে না। ভালো না লাগলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তারা সেখানেই থেমে থাকেনি। আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ এদের ভালো লাগে না। এরা কথা বা লেখায় বিরোধিতা করে থেমে থাকে না। এদেশে শতভাগ বাঙালি সমাজে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছে। রক্ত ঝরেছে। প্রাণ দিয়েছেন নীরিহ বাঙালি। কিন্তু তখনো আমরা ভয় পাইনি। কারণ সংস্কৃতি ছিল সরব। রাজপথে জাগ্রত ছিল বাঙালির চেতনা। বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা ভাবে আক্রান্ত হলেও চেতনা পরাজিত হয়নি।

এখন তবে আমরা ভয় পাই কেন? কেন সংশয় ঘিরে রাখে? রাজনীতির এককেন্দ্রিকতা না স্তাবকতা এ জন্য দায়ী? না দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিক্রিয়াশীলতার চর্চায় এই ভয় আজ গ্রাস করেছে আমাদের? উত্তর যাই হোক সময় এসেছে প্রাণ মন দিয়ে বাংলা নববর্ষ পালন করার। সময় এখন ঘুরে দাঁড়াবার। কিছুদিন ধরে সময় একদমই ভালো যাচ্ছে না দেশে। একের পর এক সাম্প্রদায়িক উস্কানী, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ– সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। বিজ্ঞান শিক্ষককে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া কোনও ভাবেই সহজ সুস্থতার প্রমাণ বহন করে না। আমরা এমন সমাজ চাইনি। বিশেষত যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা আছেন দেশশাসনে। আওয়ামী লীগ যতটা বদলে যাক বা বদলানোর চেষ্টা করুক তাদের মূল শক্তি বাঙালিত্ব। তারাই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। তাদের দায়িত্ব সব থেকে বেশি।

আমরা নিশ্চিতভাবেই আশা করি এবার আবার স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ লাভ করবে বাঙালি। নববর্ষ তার জীবন থেকে ভয়, দুশ্চিন্তা, অপমান মুছে দেবে। তাকে আবার জাগিয়ে তুলবে নতুন ভাবে। ভালো নেই কপালের টিপ। ভালো নেই বিজ্ঞান। ভালো নেই মুক্তবুদ্ধি। ভালো নেই সংস্কৃতি। বাংলা নববর্ষ যেন এসব কিছুর নিরাপত্তা বিধান করে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এটাই হোক এবারের প্রত্যাশা।