শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল -|- ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

আজ বিশ্ব বাবা দিবস ॥ চোখের জ্যোতি নয়, অন্তর্জ্যােতিময় শক্তিতে বলিয়ান আবুল কাসেম

প্রকাশিত হয়েছে- রবিবার, ২০ জুন, ২০২১
||
  • প্রকাশিত সময় : জুন, ২০, ২০২১, ৭:৫৮ অপরাহ্ণ

মোখলেছুর রহমান, স্টাফ রির্পোটার :
কেউ দমাতে পারেনি। ইচ্ছাশক্তির নিকট পরাজিত সব বাধা-বিপত্তি। নিজে প্রবেশ করেছেন আলোর ভুবনে। সেই ভুবনের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ^জুড়ে। সেই বাবার নাম হাফেজ আবুল কাসেম। নিজের পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে আমৃত্যু কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সেই মানুষটির জন্ম ১৯৩০সালে। চোখের জ্যোতি নয়, অন্তর্জ্যােতিময় শক্তিতে তিনি বলিয়ান।
আজ রোববার (২০ জুন/২০২১) বিশ^ বাবা দিবসে এই বাবার কথা তুলে ধরছি। প্রবলশক্তি ও লেখাপড়ার প্রতি আসক্তি’তে শৈশবে ছুটে যান মক্তবে। হয়েছেন কুরআানে হাফেজ। তার বাড়ি গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের মইলাকান্দা গ্রামে। তার বাবার নাম কলিম উদ্দিন আহাম্মেদ। তিন ভাই আর দুই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়।
চোখের দৃষ্টিশক্তি নেই। তাঁকে নিয়ে তার বাবা কলিম উদ্দিন দুঃচিন্তায় পড়ে যান। সন্তানের চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে আনার ছুটে যান ভারতেও। দেশ ও বিদেশের অগণিত চিকিৎসক আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফল হননি। বাবা-মা আর সংসারের অন্যরা আবুল কাসেমকে নিয়ে প্রায়শঃ মন খারাপ করতেন। কি হবে, কেমন করে চলবে এই ছেলেটি! তবে কখনও ভেঙ্গে পড়েনি আবুল হাসেম। মনে সাহস, শরীরের জোর আর ইচ্ছাশক্তি নিয়ে প্রতিটি পা গুণেগুণে ভুবন জয় করেছেন।
এ প্রসঙ্গে হাফেজ মো. আবুল কাসেম, আমার বয়সের অন্যরা স্কুলে যাচ্ছে। হইহুল্লা করছে, মজার মজার পড়া পড়ছে শোনতাম। তখন শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশনে বসে থাকতাম। মনেমনে খুব কষ্ট পেতাম। একদিন বাবা আমার একটা ধরে এগিয়ে চললেন। কিছুক্ষণ পরে বাসে ছড়লাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না, বাবাও বলছেন না। যেতে লাগলাম। ঘন্টা তি’নেক পর হাজির হলাম উচু-নিচু জায়াগায়। সেটা হলো ময়মনসিংহ বাসস্টেশনের মোড়। সিঁড়ির উপরে সিঁড়িতে পা রেখে উপরে উঠলাম। সেটি ১৯৪৯সাল। সেই মাদরাসার হেফজখানায় ভর্তি হলাম। মাদরাসার প্রধান হাফেজ মো. আব্দুল আউয়াল। তার বাসায় ৪বছর থেকে হেফজ শেষ করি। প্রতিদিন যাওয়া-আসা করায় এক সময় পুরো রাস্তাটা মেপের মতো পরিটিত হয়ে উঠলো। আসলে জীবনের গল্প একটু লম্বাই…. তিনি বলতে লাগলেন এর চলে যাই ঢাকার বড়কাটরা আশরাফুল উলুম মাদরাসা, সেখান থেকে চলে যাই লালবাগ শাহী মসজিদ মাদরাসায়। সর্বশেষ পড়েছি মাওলানা আব্দুল কাদেরের বংশাল মাদরাসায়। হাফেজ হওয়ার পর ৫৪’র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিমলীগ ফেল করে, যুক্তফ্রন্ট পাস করলো। তখন নেজামী ইসলামীর সভাপতি মাওলানা আতাহার আলী সাহেব কিশোরগঞ্জ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি আমাকে নিয়ে যান তার জামিয়া এমদাদিয়া মাদরাসায়। সেখানে পাঠদান করি আর উনার ছেলেকে পড়াই। সেখানে ৩/৪বছর থেকে শ্যামগঞ্জের বাড়িতে চলে আসি।
তিনি আরো জানান, শ্যামগঞ্জে তখনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেইভাবে নেই। আমি ১৯৫৮সালে শ্যামগঞ্জ বড় মসজিদের বারান্দায় কয়েকজন ছাত্রকে কুরআন শিক্ষা শুরু করলাম। যা পরে হাফেজিয়া ফুরকানিয়া মাদরাসা নামে প্রতিষ্ঠিত করি। সেখানে ছিলাম প্রায় ১০বছর। এরপর তিনি তার বাল্য ওস্তাদ (শিক্ষাগুরু) মাওলানা মো. নাসির উদ্দিনকে নিয়ে সেই মাদরাসার নিজস্ব দ্বিতীয় ভবন নির্মাণ করেন। ৬৪বছরে এ মাদরাসা থেকে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী কুরআনে হাফেজ শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ মাদরাসাটি বর্তমানে শিক্ষার্থী ৪২ জন। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা দেশের নানা প্রান্তে। এছাড়াও সৌদি আরব, বাহরাইন, মালয়েশিয়াসহ ১৬টি দেশে মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে অনেকেই কর্মরত আচেন।
মাদরাসা কমিটির সভাপতি আবুল মুনসুর সরকার জানান, এখনো হাফেজ আবুল কাসেম মাদরাসার তদারকি করেন। বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকেন। শিক্ষার্থীদের উচ্চারণ ও সঠিকভাবে পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের তাগিদও দেন।
এ দিকে ১৯৫৬সালে আফতাবের নেছার সঙ্গে হাফেজ মো. আবুল কাসেম বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। দাম্পত্য জীবনে ছয় পুত্র আর তিন কন্যার জনক। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। নিজের জীবন দিয়ে উপলব্দি করেন সন্তানদের মানুষ করতে হবে। সন্তানদের প্রয়োজনে নিজের বাবার সদায়-সম্পদ বিলিয়ে দেন। ৩০বছরপূর্বে স্ত্রীকে হারান এতেও তিনি ভেঙে পড়েনি। ঘড়ির প্রয়োজন হয়নি; মেয়েকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে ছুটে এসেছেন স্টেশনে। মেয়েকে হাত ধরে এগিয়ে চলেছেন প্রত্যহ। স্টেশনে এসে ট্রেন মিস করেছেন জীবনে এমন রেকর্ড নেই। মেয়েও এসে দেখেনি বাবা নেই! সেই মেয়ে ডক্টর আশরাফুন নেছা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে এ বছর পিআরএলে রয়েছেন। আর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনিও। পেশায় গৃহিনী। ৩য় মেয়ে নাসরিন সুলতানা পান্না। তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জয়িতা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা।
আবুল কাসেমের বড় ছেলে হারুন অর রশিদ। তিনি শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। দ্বিতীয়পুত্র হলেন মামুন অর রশিদ। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনিও বাবার অনুপ্রেরণা ও বড় বোনের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামগঞ্জ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। ৩য় পুত্র হলেন জামিলুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ পুলিশে সাবইন্সপেক্টর পদে কর্মরত আছেন। ৪র্থ পুত্র আব্দুল্লাহ আল নোমান। বাবার সমাজসেবা কার্যক্রমের উদাহরণ হলেন তিনি। নির্বাচিত হয়েছেন মইলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। ৫ম পুত্র হলেন আবু সায়েম। তিনি সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার পদে কর্মরত। ৬ষ্ঠ পুত্র মাহমুদুল হাসান রানা। তিনি বেসরকারি একটি কোম্পানীতে কর্মরত আছেন। পরিবারের ৯জন সন্তানকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
হাফেজ আবুল কাসেম বলেন, পাশ্ববর্তী ডা: আফতাব উদ্দিনকে দেখে আমার বাবার খুব ইচ্ছা ছিলো সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু আমার জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন হওয়ায় শুধু আফসোস করতাম। আমি তা অনুভব করেছি। তারপর আমারও ইচ্ছে ছিলো সন্তানকে ডাক্তার বানাবো। সেই ইচ্ছেও পূরণ হয়নি। ডক্টর আশরাফুননেছা মদিনাকে নিয়ে মুমিনুন্নেসা কলেজে গিয়ে ছিলাম বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি করতে। কলেজের অধ্যক্ষ মোছা. মুসলিমা খাতুনকে বারবার অনুরোধ করায় তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন ‘এটা কী ইলেস্টিক-টানলে লম্বা হবে’। মনক্ষুন্ন হয়ে বাড়ি ফিরে মেয়েকে শ্যামগঞ্জের হাফেজ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি করি। সেই মেয়েই বিসিএস শিক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে মুমিনুন্নেসা কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। এই মেয়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হয়েছে। ডাক্তার হতে পারে নাই, ডাক্তারদের অভিভাবক হওয়ায় আমি আল্লাহপার্কের নিকট শুকরিয়া আদায় করেছি।
পৃথিবীর সকল বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ডক্টর আশরাফুননেছা মদিনা। তিনি বলেন, বাবা দিবস, প্রতিদিনই, প্রতিমুর্হুত। আমার বাবাও আমার নিকট ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা’। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সেই সময়ে সমাজের প্রতিবন্ধকতা- মেয়েদের লেখাপড়া করানো ক্ষেতে সকল বাঁধা উপেক্ষা করে তিনি শুধু আমাকে নয়, আমাদের সকল ভাই-বোনকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমি অবাক হতাম। রেলস্টেশনে পৌঁছার আগেই বাবা পৌঁছে যেতেন। ঘড়ির কাটা নয় তিনি জীবনের কাটায় সময়কে অনুধাবন করতেন, তার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতাম। ময়মনসিংহ স্টেশনে পৌঁছার পর বাবা বারান্দায় বসে থাকতেন আর আমি ওয়াটিংরুমে বসে থাকতাম। বাবা আমাদেরকে চোখ দিয়ে দেখতে পারেননি, অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন। বিশাল অন্তদৃষ্টিই আমাদের গ্রাম, পরিবার ও সমাজ পরিবর্তনের জন্য তিনি কাজে লাগিয়েছেন। সত্যিই আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্বিত।
মামুন অর রশিদ বলেন, বাবা আমাদের প্রেরণার উৎস। বাবাকে দেখেই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়ানো শিখেছি। বাবা আমাদেরকে শুধু সন্তান করে গড়ে তোলেননি, মানুষ হিসেবে গড়ে তোলতে রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। আমার বাবা এখনো আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের কোন সমস্যা হলে তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান।
আবুল কাসেম মানুষের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। দারিদ্র্যপীড়িত শীতার্তদের মাঝে এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণ, মসজিদ-মাদরাসার উন্নয়নেও এখনো অংশ নিচ্ছেন। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তিনি তরুণদেরকে ন্যায়ের পথে কাজ করার আহবান জানান।
জন্ম থেকে পৃথিবীর আলো-অন্ধকারের রূপ দেখতে পারেননি হাফেজ মো. আবুল কাসেম। তবে নব্বইয়ের কোটা পেরিয়ে শতবছর ছুঁইছুঁই সময়েও তিনি আলো ছড়াচ্ছেন। বিস্ময়কর এই মানুষটিকে গল্প শোনে অনেকেই বিস্মৃত! এ অঞ্চলে তিনি ‘সাদামনের মানুষ’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এখনও ছুটে চলেন মানবসেবায়। শুধু নিজের নয়; সন্তানদেরকেও আলোকিত করে গড়ে তোলেছেন তিনি। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে আকুতি জানান, যাঁদের দৃষ্টি আছে তারা অপদৃষ্টিতে যেন অপকর্মের সৃষ্টি না করেন। সাংবাদিক তিলক রায় টুলু বলেন, হাফেজ মো. আবুল কাসেম এ অঞ্চলে তিনি ‘সাদামনের মানুষ’ হিসাবে সবার নিকট সমাদৃত।