শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪ -|- ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০-বসন্তকাল -|- ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

অসহায় কৃষকের মুক্তির জন্য লড়ছেন গৌরীপুরের কৃতি সন্তান এডভোকেট নুরুল হক

প্রকাশিত হয়েছে- রবিবার, ২০ মার্চ, ২০২২
নিজস্ব প্রতিবেদক || দৈনিক বাহাদুর
  • প্রকাশিত সময় : মার্চ, ২০, ২০২২, ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ

বাবা জেলে, সন্তানদের খাবার নেই ঘরে। আশপাশের মানুষের দেয়া খাদ্যে দিনযাপন চলছে কৃষক পরিবারের। ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করলেও আইনগত সহযোগিতার সামর্থ্য নেই তাদের। এ নিয়ে দৈনিক যুগান্তর, স্বজন ও দৈনিক বাহাদুর ডট কমসহ একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। অসহায় পরিবারের খবর পেয়ে অসহায় কৃষকের মুক্তির জন্য আইনগত সহযোগিতা দেয়ার আশ^াস দেন গৌরীপুরের কৃতি সন্তান ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট নুরুল হক। তিনি বলেন, পত্রিকায় যখন দেখলাম, এই কৃষক ২০দিন ধরে জেলে থাকার পরেও জামিনের জন্য কেউ আবেদন করছেন না। তখন পত্রিকার খবর দেখে সেই পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনগত সহযোগিতা প্রদানের আশ^াস দিয়েছে।
এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রোববার (২০মার্চ/২০২২) তার জামিনের জন্য বিজ্ঞ আদালতে আবেদন করেছেন ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট নুরুল হক। বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেল হাজতে থাকা এবিএম ঈশারুল্লাহ’র ভাই ওমর ফারুক।
অপরদিকে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর শনিবার (১৯মার্চ/২০২২) কৃষক এবিএম ঈশারুল্লাহ’র মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। মানববন্ধনে ঈশারুল্লাহ’র মুক্তি ও বিদ্যুৎ বিলের গ্রাহক হয়রানি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বক্তরা জানান, হয়রানিমূলক ভৌতিক বিদ্যুৎ বিল ও মামলা দিয়ে কৃষক এবিএম ঈশারুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তিনি অসুস্থ্য ও দরিদ্র মানুষ, মামলা চালানো ও জামিন আবেদনের সামর্থ্যও নেই। তাই অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি চাই।
মানববন্ধন কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন ঈশারুল্লাহর ভাই ওমর ফারুক, তার ছেলে মো. আল নাহিয়া, রামগোপালপুর বাসস্ট্যান্ড মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. ইব্রাহিম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আলা উদ্দিন, কৃষক আবু নাঈম, মোজাাহিদুল ইসলাম, আবু সিদ্দিক, ডা. ফখর উদ্দিন, আবু রায়হান, মোহাম্মদ হোসেন, আবুল কাশেম, মো. ইউসুফ আলী, আজিজুল হক, নাজমুল ইসলাম, এনামুল হক, প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান, ব্যবসায়ী মো. সুরুজ আলী, আব্দুল গণি, গিয়াস উদ্দিন, হাবিবুল ইসলাম, তোতা মিয়া, আজিজ উদ্দিন প্রমুখ।
জানা যায়, উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামের মরহুম মাওলানা আবুল বাশারের পুত্র এবিএম ঈশারুল্লাহ। ২০১২সনে সেচ কার্যক্রমের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ নেন। প্রথম বছরে তার বিদ্যুৎ বিল আসে ৯হাজার ১৭৩টাকা। এরপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারও করেননি, বিলও দেননি। ২০১৪সালে ডিজিটাল মিটার স্থাপন ও বিল পরিশোধ করে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার জন্য পত্র দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। যেহেতু সেচ কার্যক্রম বন্ধ তাই তিনি আর বিদ্যুৎ বিভাগে যোগাযোগ করেনি। বিক্ষুব্দ হয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ মিটার খুলে নিয়ে যায় ও লাইন বিচ্ছিন্ন করে।

এবিএম ঈশারুল্লাহর স্ত্রী জাহানারা খাতুন জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে করোনাপ্রতিরোধের টিকা দেয়ার জন্য গৌরীপুরে যাওয়ার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। ঈশ^রগঞ্জ আবাসিক প্রকৌশল দপ্তরের অধিনে বিদ্যুৎ হিসাব নং ৫৫৫৬/বি, গ্রাহক নং ৭৬১০৬৮৯০, বই নং কে ৫৬, ওয়াক অর্ডার ২০৮৫নং সেচ গ্রাহক ছিলো আমার স্বামী। তিনি জানান, তার বাড়িতে কোনো কর্মকর্তা আসেনি, কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি, অবৈধ বিদ্যুৎও ব্যবহার করেনি অথচ স্বামীর বিরুদ্ধে ১০৮৮/১৭ নং ও ৩০৯/১৮নং ২টি মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, তার স্বামীর শরীরে টিউমারের থাকায় অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। ১০৮৮নং মামলায় ২০১৮সনে গ্রেফতার হন। তখন এলাকাবাসী ও আত্মীয় স্বজন ২০১৮সনের ১৩ সেপ্টেম্বর ৪০হাজার বিদ্যুৎ অফিসে জমা দিয়ে জামিনে নিয়ে আসেন। যেহেতু আমার স্বামী বিদ্যুৎ ব্যবহার করে নাই, তাই আদালতের বিজ্ঞ বিচারক বিদ্যুৎ বিল সংক্রান্তে তদন্ত দেন। সেই তদন্ত রিপোর্ট বিদ্যুৎ বিভাগ আজও দেয়নি। তবে ওই বছরের ১৭ অক্টোবর ৩০৯/১৮নং আরেকটি মামলা করে। এ মামলায় আমার স্বামী বর্তমানে জেলহাজে রয়েছেন!
তিনি আরো জানান, আমার স্বামী জেলে, বিদ্যুৎ লাইন, মিটার ও তার সবকিছু খুলে নিয়ে গেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারপরেও মার্চ/২১ বিল দেয়া হয়েছে ১লাখ ৮১হাজার ৯৯টাকা।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ খান আব্দুল হালিম সিদ্দিকী। তিনি জানান, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তাকে ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এক ঘটনায় ২টি মামলার ১নং স্বাক্ষী ও তৎকালীন সময়ের ঈশ^রগঞ্জের আবাসিক প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার নিরঞ্জুন কুন্ডু এ প্রতিনিধিকে বলেন, এক গ্রাহকের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা! সেই সময় কেন হয়েছিলো, এই মুর্হুতে কিছু বলতে পারছি না।
বিদ্যুৎ গ্রাহককে অহেতুক হয়রানির তীব্র-নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মিন্টু। তিনি জানান, কর্তব্যে অবহেলা ও কৃষক জেলে এ ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন গৌরীপুর শাখার সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১০৮৮/১৭নং মামলায় এবিএম ঈশারুল্লাহকে বিজ্ঞ বিচারক জামিন দেন এবং অযৌক্তিক বিল করায় বিদ্যুৎ বিভাগকে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন না দিয়ে, তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা দুঃখজনক ঘটনা।
ঈশ^রগঞ্জ আবাসিক প্রকৌশলী বিদ্যুৎ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মোমেন জানান, এই গ্রাহক ২০১৯সনে এসেছিলো, কোর্টের তদন্তের নির্দেশ নিয়ে আসতে বলেছিলাম, এরপরে আর আসেননি। দু’টি মামলার ঘটনা পূর্বতন কর্মকর্তাদের সময়ের তাই এ প্রসঙ্গে আমি কিছু বলতে পারছি না।
এদিকে ঈশারুল্লাহর ভাই ওমর ফারুক জানান, ঈশ^রগঞ্জ আবাসিক প্রকৌশলীর দপ্তরের আওতাধীন একজন সেচ গ্রাহক ছিলেন তার ছোট ভাই ঈশারুল্লাহ। ২০১২সনে সেচ চালানোর পর আর সেচ চালায়নি। ওই বছরের বিদ্যুৎ বিল ৯হাজার ১৭৩টাকা পরিশোধও করেনি। এ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য ২০১৩সনের ২৩নভেম্বর পত্র প্রেরণ করেন। এ পত্রের পরেও আর্থিক ও শারীরিক দুরবস্থার জন্য এ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারেনি ঈশারুল্লাহ। ‘সেচ গ্রাহকের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধসহ ডিজিটাল মিটার স্থাপন’ সংক্রান্ত পত্র প্রদান করেন। এ পত্রে ১০/১২/২০১৪খ্রিঃ তারিখের মধ্যে বিল (ভৌতিক বিল) ৪৩,৭৫৪টাকা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। আমার ভাইয়ের শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং সেচ কার্যক্রম সচল না থাকায় বিদ্যুৎ বিল দেয়নি। ক্ষুব্দ হয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ মিটার খুলে নিয়ে যায়। মিটার নেই, বিদ্যুৎ নেই, নেই সেচ কার্যক্রম তারপরেও ভৌতিক বিল থেমে থাকেনি!
অপরদিকে ২০১৫সালের ৩১ডিসেম্বর ৬৭,১৯৭টাকা পরিশোধ করে সেচ মৌসুমে পুনঃসংযোগ গ্রহনের পূর্বে বিল পরিশোধ করতে বলা হয়। বিল পরিশোধ ব্যতিত পুনঃসংযোগ সম্ভব নয় বলেও পত্রে উল্লেখ থাকে। সংযোগও নেয়নি, বিলও পরিশোধ করেনি এবিএম ঈশারুল্লাহ। তারপরেও বিদ্যুৎ বিভাগ ২০১৬সনের আগস্ট মাসে ৪৩২০টাকা, সেপ্টেম্বরে ৪২০২টাকা, অক্টোবরে ৪০১১টাকা, নভেম্বরে ২২৬টাকা, ডিসেম্বরে ৩৬টাকা বিদ্যুৎ বিল করে। ২০১৭সনের জানুয়ারিতে ৩৮৫২টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৪০৪২টাকা, মার্চে ৪০৪৩টাকা অনুরূপভাবে মার্চ/২০১৭ ১লাখ ২০হাজার ৬০০শ টাকার বিদ্যুৎ বিল দেয়া হয়। এ বকেয়া টাকা দাবী করে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন, মামলা নং ১০৮৮/১৭। ১৯/০৪/২০১৭ তারিখে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বলে মামলার বাদী বিউবো ময়মনসিংহের সহকারী প্রকৌশলী কাজল কুমার সাহা উল্লেখ করেন। অত্র মামলার এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয় এবিএম ঈশারুল্লাহ অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করার সময় হাতে-নাতে ধরেছেন তার জন্য ৫২৫টাকার বিদ্যুৎ চুরি করেছে।
এদিকে মামলা দায়ের-বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করণের নিমিত্তে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল আদালতে মামলা দায়েরের পরেও ভৌতিক বিলকরণ থামেনি! ২০১৭সালের এপ্রিলে ৩৮৫০টাকা, মে মাসে ৪২৩৯টাকাসহ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১লাখ ২৮হাজার ৮১২টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিল দেয়া হয় এ কৃষককে। এ বকেয়া টাকা উত্তোলনের জন্য ময়মনসিংহ বিউবোর সহকারী প্রকৌশলী মো. আজিজুর রহমান বাদী হয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবারও মামলা করেন। মামলা নং ৩০৯/১৮। এ মামলায় আবারও উল্লেখ করা হয় ৮/২/২০১৮খ্রিঃ তারিখে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অভিযানে এই বাদী অভিযান চালিয়ে দেখতে পান ঈশারুল্লাহ অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, যার রাজস্ব ক্ষতি হিসাবে ১২১০টাকা ধার্য্য করা হয়।
অপরদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় মামলা, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নকরণের কথিত গল্পের পরেও ভৌতিক মিটারের বিল বাড়তেই থাকে। ২০১৮সনের জানুয়ারি মাসে ৪০৩০টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩১টাকা, ২০২০সনের অক্টোবরে ২৩হাজার ২৬৩টাকা, নভেম্বরে ৪হাজার ২২৭টাকাসহ ২০২১সনের মার্চ মাস পর্যন্ত ১লাখ ৮১হাজার ৯৯টাকার বিদ্যুৎ বিল প্রদান করা হয়েছে জেলে থাকা এ কৃষককে।
গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিলের ২০২১সনের মার্চ মাস পর্যন্ত ১লাখ ৮১হাজার ৯৯টাকা উল্লেখ রয়েছে। তবে ঈশ^রগঞ্জের আবাসিক প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া কবীর বুধবার (১৬মার্চ/২০২২) এ প্রতিনিধিকে জানান, এবিএম ঈশারুল্লাহ এর এখন বিদ্যুৎ বিল ৯৪হাজার ৩২৯টাকা!