বাহাদুর ডেস্ক :
দেশে মোট ১৫ জন নারী ট্রেনচালকের একজন সালমা খাতুন। তিনি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ট্রেনের চালক। এ রুটের প্রথম নারী ট্রেনচালক হওয়ায় তাকে ঘিরে এ রুটের যাত্রীদের আগ্রহের শেষ নেই। প্রায়ই অনেক যাত্রীর নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তাকে। তাকে ঘিরে তরুণী যাত্রীদের আগ্রহ অনেক। অনেক তরুণী সালমাকে দেখে অনুপ্রেরণা পান।
সালমা বলেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লাইনে ট্রেন চলানোর কাজ শুরু হয়। একজন নারী ট্রেন চালাচ্ছেন- তা দেখে অনেকেই তাকিয়ে থাকেন, হাসেন; আবার কথাও বলেন। অনেকেই জানতে চান, নারী হয়ে কীভাবে ট্রেন চালাচ্ছি। তখন আমিও বলি, এটা কোনো কঠিন কাজ না। মানুষ চাইলে সবই পারে। আর নারীরাও পারে।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুরগামী ট্রেনে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক। বিশেষ করে অনেক ছাত্রী চলাচল করেন। অনেক ছাত্রী বলেন, ‘আপা, আমিও আপনার মতো হবো।’ তাদেরকেও বলি- নারীরা সব পারে। কঠিন কোনো কাজ নয়। নারীরা এ পেশায় যত বেশি আসবে, তাদের সুযোগ-সুবিধা ততই বাড়বে।
তবে সালমা বলেন, এটা কঠিন দায়িত্ব। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারাক্ষণ ট্রেনের আসনে বসে থাকতে হবে। চারদিকে চোখ রাখতে হবে। এ ছাড়া কখনও ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বাসায় ফিরতে পারবেন না; তা যত রাতই হোক না কেন। তা ছাড়া ইঞ্জিন বিকল হলে যাত্রীরাও ক্ষেপে যায়। রেগে গিয়ে তেড়ে আসে। আবার নারী দেখে নীরবে চলে যায়। মাঝেমধ্যে দুর্বৃত্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। এ সবকিছু অবশ্যই চ্যালেঞ্জের।
বাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক বা লোকোমোটিভ মাস্টার সালমা খাতুন। লোকোমোটিভ মাস্টার এমন একটি পেশা, যেটি এখন পর্যন্ত নারীর উপযোগী পেশা বলে বিবেচিত নয়। কাজেই প্রথম নারী ট্রেনচালক হিসেবে সালমা খাতুন যখন বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগ দিয়েছিলেন, তখন সেটা আলোড়ন তুলেছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যমে।
২০০৪ সাল থেকে সালমা খাতুন ট্রেনচালক হিসেবে ঢাকা বিভাগে কর্মরত। রেলের জটিল সব যন্ত্রপাতি এখন তার জীবনের অংশ। ১৯৮৩ সালের ১ জুন সালমা খাতুন টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুরের অর্জুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সালমা খাতুনের স্বামী হাফিজ উদ্দিন জজকোর্টে কাজ করেন। তাদের সংসারে আদিবা বিনতে লাবণ্য (৭) ও বাবিয়া ইরতিজা (১) নামে দুই মেয়ে রয়েছে।
২০০০ সালে অর্জুনা মুহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০০২ সালে কুমুদিনী সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন সালমা। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ২০১৫ সালে কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছেন তিনি। এর আগে তিনি বিএড কোর্স সম্পন্ন করেছেন।
সালমা খাতুন বলেন, ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করার পরই রেলওয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি দেখি। এর পর আমি পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পাই।
তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ব্যতিক্রমধর্মী কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল আমার। যেটা সাধারণত কেউ করে না তেমনি একটু চ্যালেঞ্জিং ধরনের কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। এ ইচ্ছা পূরণ করাটা আমার জন্য এত সহজ ছিল না। কেননা, আমি ছিলাম গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তা ছাড়া আমাকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্যও আমার বাবা-মায়ের ছিল না। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবে জেদ করি- আমি পড়বই। বাবা-মা আমাকে তখন এইচএসসিতে ভর্তি করেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন লেগেই ছিল। এ কারণে এইচএসসি পাস করার পর আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আমার পরিবার থেকে বলা হয়, আর পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়। তখন মনে হলো, আমার একটা কিছু করা দরকার, যেন আমার পরিবারকে কিছুটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে পারি। আমি যখন একটা কিছু করার উপায় খুঁজছিলাম তখন আমার বড় ভাই একদিন বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে বললেন, তুমি চাইলে এখানে আবেদন করতে পার। চাকরির এ সুযোগটি আমার ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায়। আর তাই আমি আবেদন করি।’
সালমা খাতুন বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাই। মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত কর্তাব্যক্তিরা খুব আগ্রহ নিয়েই আমার কাছে জানতে চান- এ চাকরিটি আমি করতে পারব কিনা? বললাম- আমি পারব। এ চাকরিটি আমি করতে চাই। তারাও আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন।’
তিনি বলেন, এটা চ্যালেঞ্জিং তবে আমার জন্য আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ আমার দুটো সন্তানকে ঠিকমতো সময় দিতে পারি না। ডিউটিতে আসার জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। রান্না করে বাচ্চাদের খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে তার পর আসতে হয়। আবার সময়মতো অফিসে উপস্থিত হতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে আমার স্বামী সবথেকে বেশি সহযোগিতা করেন। আত্মীয়স্বজনদের কাছে বাচ্চাদের রেখে কাজে আসি। তারপরও কাজ থেকে ফিরতে দেরি হলে আমি বাচ্চাদের জন্য টান অনুভব করি।
সালমা খাতুন বলেন, এ পেশায় এসে সবথেকে বেশি কষ্ট ও খারাপ লাগে যখন দেখি, মানুষ ট্রেনের সামনে চলে আসে। এ ছাড়াও কিছু পথচারী অসচেতন। এগুলো যখন দেখি, খুব খারাপ লাগে।
টি.কে ওয়েভ-ইন